কভিড-১৯-এর নতুন ভ্যারিয়েন্ট ওমিক্রন চোখ রাঙাচ্ছে। ইতোমধ্যে সরকার সবার জন্য টিকার ব্যবস্থা করছে। উল্লেখযোগ্য নাগরিক টিকার আওতায় এসেছেন। এমনকি শিশুরাও টিকার আওতায় আসছে। স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয় ১২ থেকে ১৭ বছর বয়সী স্কুলশিশুদের টিকা দিচ্ছে। তাদের ফাইজারের টিকা দেওয়া হচ্ছে। টিকা নিয়ে স্কুলের শিশুদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উৎসাহ লক্ষ্য করা গেছে। ফাইজারের টিকা এখন জেলা সদরে পাঠানো হয়েছে। এখনই আমাদের একটি কার্যকর নজরদারি ব্যবস্থা চালু করা  উচিত। এটা জরুরি যে আমরা ৬৫ বছরের কম বয়সী ভ্যাক্সজেভরিয়া টিকা গ্রহণকারীদের জন্যও এমন একটি শক্তিশালী নজরদারি শুরু করি।
এই টিকাগুলো দ্বারা প্রদত্ত সুরক্ষার মূল্যায়নের জন্য হিউমারাল (অ্যান্টিবডি) এবং সেলুলার (কোষভিত্তিক) উভয় অংশই অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত। এখানে স্পষ্টভাবে বলা দরকার, শুধু অ্যান্টিবডির উপস্থিতি, এমনকি তা যদি ভাইরাসকে নিরপেক্ষ করে দিতে সক্ষমও হয়ে থাকে, তা সত্ত্বেও সুরক্ষার জন্য যথেষ্ট নয়। টিকার বুস্টার ডোজ, যা কিছু দেশ এরই মধ্যে বাস্তবায়ন করছে, তা আমাদের দেশে বাস্তবায়নের আগে আমাদের জানতে হবে, কতক্ষণ একটি টিকা বা সংক্রমণ একটি টিকাপ্রাপ্ত বা সংক্রমিত ব্যক্তিকে সুরক্ষা দেয়। আমাদের এই রোগতাত্ত্বিক সত্যকে উপলব্ধি করতে হবে যে, একটি টিকার প্রভাব বা জীবাণু দ্বারা সংক্রমণের আশঙ্কা এবং পরবর্তীকালে সুরক্ষার বিকাশ বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের ওপর নির্ভর করে, যথা- বয়স, লিঙ্গ, জাতি, গোত্র, পেশা, সাক্ষরতা, গৃহের অবস্থা বা অবস্থান এবং প্রকার পরিবেশ ও ভূতাত্ত্বিক অবস্থা, ভৌগোলিক, জলবায়ুসহ আর্থসামাজিক অবস্থা। এসব বৈশিষ্ট্যের পরিপ্রেক্ষিতে এবং পটভূমির আলোকে একই রোগের প্রভাব তাই বিভিন্ন জনসংখ্যা এবং অবস্থানে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। বিভিন্ন ধরনের টিকার কার্যকারিতা, তাদের স্থায়িত্ব এবং তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে জানার জন্যও এই অধ্যয়ন গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের সিদ্ধান্তগুলো হতে হবে সতর্ক, বাস্তববাদী, জ্ঞানভিত্তিক ও অভিজ্ঞতামূলক আলোচনার ভিত্তিতে এবং চিন্তাশীল বিশ্নেষণ, তাদের কার্যকারিতা ও দক্ষতার পরিপ্রেক্ষিতে। টিকা দেওয়ার জন্য আমাদের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, সে সম্পর্কে আমাদের নিজেদের জিজ্ঞাসা করতে হবে- কাকে উচিত এবং কাকে টিকা দেওয়া উচিত নয়, যেহেতু এর সরবরাহ সীমাবদ্ধ। সিদ্ধান্তটি নির্ভর করা উচিত টিকার কার্যকারিতা, দক্ষতা এবং নিরাপত্তার ওপর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতিতে অভিযোগ করা হয়, রিপাবলিকানরা বাইডেনের টিকা পরিকল্পনা ব্যর্থ করার জন্য সচেষ্ট। এটি কি একটি কারণ হতে পারে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার এখন এমনকি পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করছে? এদের মৃত্যুর হার এবং সংখ্যা অতি নগণ্য- বয়োপ্রাপ্তদের প্রতি ১০ হাজার জনের আলোকে আটজনের কম। আমরা কি একমত হতে পারি না, মৃত্যু প্রতিরোধকেই অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত? মানুষ কি সর্দি, কাশি এবং জ্বর নিয়ে নিজেদের ব্যস্ত রাখবে? কত দিন? কিন্তু সমস্যা হলো, কবে আমরা একমত হবো যে কভিড-১৯ থেকে এখন যে মৃত্যু ঘটছে, তা উদ্বেগজনক নয় এবং এখন অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা ও রোগ প্রতিরোধ এবং সেবার প্রতি প্রয়োজনীয় নজর দিতে হবে।
জনপদে রোগের অনাক্রম্যতাকে একটি দূরবর্তী স্বপ্ন হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে। রোগের বিরুদ্ধে টিকা বা সংক্রমণ যে অনাক্রম্যতা বিকাশ করে, তা স্বল্পস্থায়ী সে কারণে। টিকা বা সংক্রমণ বারবার প্রয়োজন হবে অনাক্রম্যতা তৈরির জন্য। এটি আসলে প্রতিবছর ইনফ্লুয়েঞ্জা টিকার অনুকরণের মতো হতে পারে। একটি সত্য স্পষ্ট- টিকা নেওয়ার পরও সংক্রমণ অস্বাভাবিক নয় এবং সম্ভবত এর হার প্রাকৃতিক সংক্রমণের চেয়ে বেশি, যদিও এসব ক্ষেত্রে রোগীর মধ্যে মারাত্মক পরিণতি নগণ্য। একটি প্রশ্ন- একবার সংক্রমিত বা টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের কোনো রকম পুনঃসংক্রমণের ভয় ছাড়াই স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেওয়া উচিত কিনা? এ ক্ষেত্রে তাদের মাধ্যমে যাতে অন্যরা, যাদের মধ্যে সংক্রমণ এবং মৃত্যু বেশি হতে পারে, তাদের বিচ্ছিন্ন করে রাখতে হতে পারে। হ্যাঁ, আমরা একটি কৌশলী এবং নিয়ন্ত্রিত এক্সপোজারের কথা বলছি। আমাদের এই অপ্রীতিকর সত্যটি মেনে নিতে হবে, মানুষ মারা যাবে কভিড-১৯ থেকে না হয় অন্যান্য রোগে। কভিড-১৯ থেকে কিছু মৃত্যু রোধ করার বীরত্বপূর্ণ প্রচেষ্টা অথচ অন্যান্য অসুস্থতা থেকে মানুষের মৃত্যু রোধ করার জন্য সামান্য কিছু করা কোনো সংবেদনশীল বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা হতে পারে না। কভিড-১৯ থেকে বেঁচে অন্যান্য অসংক্রামক রোগে মৃত্যু অর্থবহ হতে পারে না।
যতক্ষণ পর্যন্ত কভিড-১৯ থেকে মৃত্যু কম হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা ঝুঁকি নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। দীর্ঘমেয়াদি কভিড-১৯, যার সম্পর্কে বাংলাদেশে আমাদের কাছে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য নেই, সেটা বাদ দিলে কভিড-১৯ থেকে এখন দৈনিক মৃত্যুর সংখ্যা কম। আমাদের বিবেচনা করা প্রয়োজন যে বাংলাদেশ প্রতিদিন দুই হাজার ৭০০-এরও বেশি মানুষকে হারায় অন্যান্য রোগ এবং দুর্ঘটনায়। সময় এসেছে, আমরা নিজেদের প্রশ্ন করি, কভিড-১৯ সম্পর্কিত পরিষেবাগুলো নিশ্চিত করার জন্য অন্যান্য কারণে মৃত্যুর দিকে কম মনোযোগ দেওয়া আমাদের জন্য ঠিক কিনা। তাই কভিড-১৯ নিয়ন্ত্রণে আমাদের কৌশল পুনর্বিবেচনার সময় এসেছে।
আবু মুহাম্মদ জাকির হোসেন: রোগতত্ত্ববিদ; বাংলাদেশ হেলথ ওয়াচের কার্যকরী দলের সদস্য