বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের সর্বাধিনায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তার সহযোদ্ধা হিসেবে লড়ে গেছেন একজন সাধারণ নারী, যিনি পরে হয়ে ওঠেন বাংলার মা। তিনি বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন নেছা মুজিব। তিনি বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। তার ছিল প্রখর স্মৃতিশক্তি, তীক্ষষ্ট বুদ্ধি, অসীম সাহস। বিচক্ষণতার সঙ্গে যে কোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় ধীর-স্থির, শান্ত এক নারী। তিনি প্রকৃতই আদর্শ নারী। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ঢাকাতে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কথা বেগম মুজিবের বর্ণনায়- '২৫শে মার্চ সেই ভয়াবহ রাত। অন্ধকার শোবার ঘরটাতে শুয়ে শেখ সাহেব শুনছিলেন বোমায় বিধ্বস্ত ঢাকার আর্তনাদ। উত্তেজনায় এক এক সময় উঠে বসছিলেন তিনি। ঠিক এমনি এক মুহূর্তে গুলির একটি টুকরো জানালা ভেদ করে ছোট ছেলে রাসেলের পায়ে আস্তে করে লাগে। অন্ধকারে হাতড়ে গুলিটা কুড়িয়ে নিয়েছিলেন শেখ সাহেব। আর সেই দুঃসহ রাতেই নরপিশাচরা তাঁকে বন্দী করে নিয়ে গিয়েছিল।' (বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র; ৮ম খণ্ড; পৃ. ৫১৩)

এর পর বাড়িতে ছিলেন বেগম মুজিব আর দুই ছেলে শেখ জামাল, শেখ রাসেল। ২৬ মার্চ ১৯৭১ কারফিউ চলছিল আর থেমে থেমে গুলির শব্দ আসছিল তাদের কানে। বিভীষিকাময় হয়ে উঠেছিল চারদিক। ধানমন্ডি বালিকা বিদ্যালয়ে সারি করা কামানগুলো তাক করা ছিল বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে। ভয়ে জানালাগুলো বন্ধও করতে পারেননি। এরই মধ্যে এ বাসা ও বাসা করে বড় ছেলে শেখ কামাল এলেন বাসায়। আবার রাত এলো। ইয়াহিয়া খান হিংস্রভাবে চিবিয়ে চিবিয়ে বিবৃতি দিলেন। আর এতেই নিজেদের অবস্থান বুঝে নেন বঙ্গমাতা। তাই আর সময় নষ্ট না করে ছোটো ছেলেকে নিয়ে প্রাচীর টপকে প্রতিবেশী এক ডাক্তারের বাসায় আশ্রয় নিলেন। অন্য ছেলেরাও পালালেন অন্য দিকের দেয়াল টপকে। তারা ৩২ নম্বর ধানমন্ডির যে বাড়িতে ছিলেন, পরে পালালেন, সেই বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা চলল ২৬ মার্চ ১৯৭১ রাত ১১টা থেকে ভোর ৫টা পর্যন্ত। বঙ্গমাতার বিচক্ষণতায় সেদিন বেঁচে গেল বঙ্গবন্ধুর পরিবার। এর পরপরই বড় ছেলে শেখ কামাল চলে যান ভারতে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে। ২৭ মার্চ ১৯৭১ সকালে বঙ্গমাতা তার দু'সন্তানকে নিয়ে আবার স্থান পরিবর্তন করলেন। পুরো দেড় মাস এ বাসা ও বাসা করে থাকলেন কোনো রকম। এর পর আশ্রয় নিলেন মগবাজারের একটি বাসায়। সঙ্গে বড় মেয়ে শেখ হাসিনা, জামাই এম.এ. ওয়াজেদ মিয়া, মেয়ে শেখ রেহানা, ছেলে শেখ জামাল এবং শিশুপুত্র শেখ রাসেলসহ কয়েকজন। বড়কন্যা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন অন্তঃসত্ত্বা। এরই মধ্যে ১২ মে ১৯৭১ পাকিস্তানি বাহিনী ঘেরাও করে ফেলে মগবাজারের এই বাসা। একজন কর্মকর্তা এসে বঙ্গমাতাকে জানালেন, তাদের তত্ত্বাবধানে অন্য কোথাও যেতে হবে। কী করবেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না তিনি। হঠাৎ বঙ্গমাতা যেন বেশ দৃঢ়চেতা হয়ে ওঠেন। মনোবল সঞ্চার করে কড়াভাবেই কর্মকর্তাকে জানালেন- লিখিত কোনো আদেশ না পেলে তিনি কারও কথায় কোথাও যাবেন না। উত্তরে কর্মকর্তা উদ্ধত আচরণ করলেন। জানালেন, ভালোভাবে তাদের সঙ্গে না গেলে অন্য পন্থা গ্রহণ করা হবে। উপায়ান্তর না দেখে বঙ্গমাতা সম্মত হলেন। শুধু বললেন, তার সঙ্গে মগবাজারের বাসায় যারা আছেন প্রত্যেককে তার সঙ্গে থাকতে দিতে হবে।

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১-এ আত্মসমর্পণ করল পাকিস্তানি বাহিনী। ৬ ডিসেম্বর ভারত স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে। পরিবারের সবাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জন্য কাঁদছিলেন। তাদের আশঙ্কা- এবার তাদের বাবাকে হয়তো আর বাঁচিয়ে রাখবে না পাকিস্তান বাহিনী। একদিকে স্বাধীনতার স্বীকৃতি পেয়ে পরম প্রশান্তি, অন্যদিকে প্রিয়জনের মৃত্যুশঙ্কা। বঙ্গমাতা কিছুটা যেন দিশেহারা, বিচলিত। এরই মধ্যে সন্তানদের সান্ত্বনাও দিচ্ছিলেন পরিস্থিতি মোকাবিলায়। ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকালে যখন পাকিস্তানি আর্মি সরিয়ে নেওয়া হচ্ছিল, তখন এ বাড়ি থেকে শুধু সিভিল আর্মড অফিসার দু'জনকে সরিয়ে নেওয়া হয়। প্রধানত আর্মিদের শৃঙ্খলে বন্দি রাখতেই এ দু'জন অফিসারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। আর্মড অফিসারদের নিয়ে যাওয়া হলে, অন্যদের না নেওয়ায় তারা বেশ বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছিল।

সুপা সাদিয়া: গবেষক ও সংগঠক

supasadia@yahoo.com