- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত ও একটি সুপারিশ
নৌপথ
লঞ্চ দুর্ঘটনার তদন্ত ও একটি সুপারিশ

গত ২৩ ডিসেম্বর রাত ৩টায় ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঢাকা থেকে বরগুনাগামী 'এমভি অভিযান-১০' লঞ্চে আগুন লেগে ৪৪ যাত্রী দগ্ধ হয়ে মারা যান। আরও অন্তত ১০০ দগ্ধ যাত্রীকে বরিশাল শের-ই-বাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউট ও ঝালকাঠি সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। কতজন নিখোঁজ রয়েছেন, তা এখনও জানা যায়নি। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, এ লঞ্চের ধারণক্ষমতা রাতের বেলায় চলাচলের কারণে ছিল ৪২০ জন। ভুক্তভোগী যাত্রীদের ভাষ্য অনুযায়ী, লঞ্চে যাত্রীসংখ্যা ছিল সাত-আটশ। যাত্রার সময় সদরঘাটে রক্ষিত রেজিস্টারে উল্লেখ করা হয়েছে ৩১০ জন।
মৃতের সংখ্যা বিবেচনায় বাংলাদেশে স্মরণকালের সবচেয়ে বড় লঞ্চ দুর্ঘটনা ঘটে ২০০৩ সালের ৮ জুলাই। ঢাকা থেকে লালমোহনগামী 'এমভি নাসরিন-১' চাঁদপুরের ডাকাতিয়া এলাকায় অতিরিক্ত যাত্রী ও মাল বোঝাইয়ের কারণে পানির তোড়ে তলা ফেটে যায়। তাতে দুই সহস্রাধিক যাত্রীসহ লঞ্চটি ডুবে যায়। ওই দুর্ঘটনায় সরকারি ভাষ্যমতে, উদ্ধারকৃত মৃতদেহ ৬৪১। কিন্তু বেসরকারি হিসাবে প্রায় ৮০০। ২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনায় ডুবে যায় 'এমভি সালাউদ্দিন-২' নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে ৩৬৩ যাত্রী মারা যান। ২০০৫ সালে 'এমএল মিতালি' ও 'এমএল মজলিশ' নামে দুটি ছোট লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর ডুবে গিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ১৯৮৬ সালে 'অ্যাটলাস স্টার' নামে একটি লঞ্চ ডুবে ২০০ যাত্রী মারা গিয়েছিল। লঞ্চটি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। ২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আজহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে 'এমভি জলকপোত' এবং 'এমভি রাজহংসী' নামে দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে 'রাজহংসী' লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়। ওই দুর্ঘটনায় লঞ্চের ১৬২ যাত্রী নিহত হয়েছিল। এ ছাড়া ২০০৫ সালে একটি ফেরি ডুবে গিয়ে ১১৮ যাত্রী নিহত হয়।
লঞ্চ দুর্ঘটনার কারণ অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন, ঘূর্ণিঝড়, নির্মাণ ও যান্ত্রিক ত্রুটি, লঞ্চে লঞ্চে পাল্লা, মুখোমুখি সংঘর্ষ, মাস্টারের গাফিলতি, ডুবোচরে আটকানো ইত্যাদি। কিন্তু লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনা বাংলাদেশে লঞ্চ দুর্ঘটনার ইতিহাসে এই প্রথম। পত্রিকান্তরে প্রকাশ, লঞ্চের মালিক গন্তব্যে পৌঁছানোর সময় কমিয়ে আনার জন্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়াই কর্তৃপক্ষের অনুমতি ব্যতিরেকে নতুন রিকন্ডিশন্ড ইঞ্জিন লাগিয়েছেন। তা ছাড়া ওই লঞ্চে কর্মরতদের গাফিলতি ছিল। আগুন লাগার পরও তারা লঞ্চটি তীরের দিকে না চালিয়ে গন্তব্যের দিকে চালানো হচ্ছিল। ফলে যা ঘটার তাই ঘটেছে। জাতিকে ৪৪টি তাজা প্রাণ পুড়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখতে হয়েছে। ৪৪টি পরিবারের যে ক্ষতি, তা কখনও পূরণযোগ্য নয়।
যাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য একটি লঞ্চে থাকা উচিত লাইফ জ্যাকেট বা লাইফ বয়া, অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম। বাকেটে পানি বা বালি ইত্যাদি লঞ্চে থাকলেও সেটি এমনভাবে ছিল যে, আগুন লাগার সময় যাত্রীরা ব্যবহার করতে পারেনি। এসব জননিরাপত্তামূলক বিষয় দেখার দায়িত্ব কার? নৌপরিবহন অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা কোনোক্রমেই এর দায়-দায়িত্ব এড়াতে পারেন না।
নৌ-দুর্ঘটনা সংক্রান্ত বর্তমানে যে আইনটি প্রচলিত, সেটি হলো 'দ্য ইনল্যান্ড শিপিং অর্ডিন্যান্স, ১৯৭৬'। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে সামরিক আইনকে বৈধতা দানকারী পঞ্চম সংশোধনী বাতিল হওয়ার পরও ওই সময়ে প্রণীত আইনটি এখনও কার্যকর। সর্বোচ্চ নির্বাহী কর্তৃপক্ষের চূড়ান্ত নির্দেশনা থাকার পরও নৌপরিবহন মন্ত্রণালয় নতুন কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেনি। অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন আইন, ২০১৯ নামে একটি খসড়া আইন প্রণয়ন করা হয়েছিল। তবে শোনা যায়, শাস্তির মেয়াদ মালিকদের মনঃপূত না হওয়ায় সেটি চূড়ান্ত করা যায়নি।
প্রচলিত অধ্যাদেশের ৫৬ ধারায় জাহাজ বা লঞ্চে কোনো প্রকার জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রপাতি (লাইফ জ্যাকেট, বয়া) 'ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট' (অগ্নিনির্বাপণ সরঞ্জাম) ইত্যাদি ছাড়া যাত্রা করলে সর্বোচ্চ দুই বছর এবং ৭০ ধারায় নিয়োজিত কর্মচারীদের দায়িত্বহীনতার জন্য পাঁচ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে। ৭২ ধারায় কোম্পানির পরিচালকদেরও সংশ্নিষ্ট দুর্ঘটনার ক্ষেত্রে দায়ী করে শাস্তি প্রদান করা যায়। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, লঞ্চ বা জাহাজের সার্ভে সার্টিফেকেট প্রদানকারী ব্যক্তি বা দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের অবহেলার ক্ষেত্রে কোনো শাস্তি বা সাজার বিধান নেই। মনে হয়, তারা দায়মুক্ত। তবে চরম দায়িত্বহীনতার জন্য তাদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা, ২০১৮ অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া যায়।
দুর্ঘটনাটির কারণ বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, মালিক কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়া লঞ্চের ইঞ্জিন পরিবর্তন করা হয়েছে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগ দিয়েছেন, আইন অনুযায়ী তাদের প্রয়োজনীয় যোগ্যতার সনদপত্র নেই। এমনকি ফায়ার ফাইটিং ইকুইপমেন্ট ও জীবন রক্ষাকারী যন্ত্রপাতি ব্যবহারে তাদের অভিজ্ঞতা আছে বলে মনে হয় না। লঞ্চের ভেতরে লাইফ বয়াগুলো এমনভাবে আটকানো অবস্থায় ছিল, যা যাত্রীদের ব্যবহারের অনুপযোগী। একটি লাইফ বয়াও কেউ ব্যবহার করতে পারেনি। কাজেই মালিক বা তার নিয়োজিত কর্মচারীরা কোনোক্রমেই এ দুর্ঘটনার দায় এড়াতে পারেন না।
দুর্ঘটনায় নিহতদের পরিবারের দুঃখকষ্ট দেখলে হৃদয় ভেঙে যায়। পরিবারের সদস্যদের আহাজারিতে ঝালকাঠির আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়েছে। কত লোক পোড়ার ক্ষত নিয়ে অসহ্য যন্ত্রণায় হাসপাতালের বেডে শুয়ে কাতরাচ্ছেন! তাদের দুঃখকষ্টের মূল্য ধার্য হয়েছে সরকার ঘোষিত কিছু অর্থ। মালিক ও অন্যান্য কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। কিছুদিন পর জামিনে তারা বেরিয়ে যাবে। বিচারের আশায় ভুক্তভোগী মানুষ দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলবেন আজীবন। অনেক পরিবার তাদের একমাত্র কর্মক্ষম ব্যক্তিকে হারিয়ে আজ দিশেহারা।
অতীতে আমরা কোনো কোনো ক্ষেত্রে দেখেছি, দুর্ঘটনার পর দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের মধ্যে কেউ কেউ মৃতের পরিবারকে একটি করে ছাগল দিতে চেয়েছেন। আবার কেউ কেউ বলেছেন, 'আল্লার মাল আল্লায় নিয়ে গেছে।' কী নির্মম পরিহাস! দায়িত্বহীনতার প্রকট নজির আর কী হতে পারে! বেফাঁস মন্তব্য না করে তারা যদি দুর্ঘটনার কারণ উদ্ঘাটন করে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনা রোধে ব্যবস্থা নিতেন তবে অনেক জীবন বেঁচে যেত। কিন্তু বাংলাদেশে তা যেন হওয়ার নয়। দেখা যায়, কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ৩/৪টি তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। জেলা প্রশাসন, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স, পুলিশ ও সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয় একটি করে তদন্ত কমিটি গঠন করে। প্রতিটি তদন্ত কমিটির কার্যপরিধি মূলত এক ও অভিন্ন। সাধারণত চারটি বিষয়ের ওপর তদন্ত করতে বলা হয়- ১. দুর্ঘটনার কারণ, ২. দায়ী ব্যক্তি চিহ্নিতকরণ, ৩. ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্ঘটনা রোধের উপায় বা প্রতিকার, ৪. সুপারিশ। প্রতিটি কমিটি অন্য কমিটির সঙ্গে সমন্বয় ছাড়া নিজেদের মতো সাক্ষ্য-প্রমাণ গ্রহণ করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে। আর এসব প্রতিবেদনে দেখা গেছে, অনেক সময় দুর্ঘটনার কারণ, দায়ী ব্যক্তি, প্রতিকার ও সুপারিশের মধ্যে প্রচুর মতানৈক্য থাকে। এসব কারণে বাস্তবায়নকারী কর্তৃপক্ষ সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করতে প্রচুর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে পড়ে। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই। প্রতিবেদনের সুপারিশগুলো আর বাস্তবায়ন করা যায় না। মন্ত্রণালয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ-সংশ্নিষ্ট বিভাগগুলোর প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে পারে। তাহলে প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কারও দ্বিমত থাকার সুযোগ থাকে না এবং সুপারিশগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে সুবিধা হয়। দায়িত্বহীনতার কারণে এভাবে মৃত্যু নিয়তি হতে পারে না।
শেখ ইউসুফ হারুন :সিনিয়র সচিব এবং নির্বাহী চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা)
মন্তব্য করুন