- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- দীপ্তিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
দীপ্তিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

আজ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ৫১তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী। আশা করা হয়েছিল, মহামারি করোনার বিরুদ্ধে মানুষ জয়ী হবে। করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার অতি সীমিত থাকবে এবং এ বছর কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উৎসব বর্ণাঢ্য আয়োজনের মধ্য দিয়ে পালন করবে। কিন্তু লক্ষণীয়, করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যুহার ঊর্ধ্বমুখী। ফলে ১২ জানুয়ারি প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর দিনটিতে অল্প পরিসরে অনলাইন অনুষ্ঠানের মধ্যেই কর্মসূচি আপাতত সীমিত থাকছে। করোনার প্রকোপ আবার কমে গেলে বৃহৎ পরিসরে প্রতিষ্ঠার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের ইচ্ছা আছে।
১৯২১ থেকে ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে ঢাকা, রাজশাহী, কৃষি, প্রকৌশল ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলেও পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চশিক্ষার চাহিদা পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিল না। তাই পরিকল্পনা অনুযায়ী ঢাকার কাছাকাছি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয় ঢাকার অদূরে গাজীপুর জেলার সালনায়। কিন্তু নানা কারণে শেষ পর্যন্ত ১৯৬৭ সালে ঢাকা থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে সাভার এলাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য নতুন স্থান নির্বাচন করা হয়। ড. সুরত আলী খানকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্পপ্রধান হিসেবে নিয়োগ করা হয়। ১৯৭০ সালের ২০ আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান সরকার এক অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে এ নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখে 'জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়'। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য হিসেবে যোগদান করেন বিশিষ্ট রসায়নবিদ অধ্যাপক ড. মফিজউদ্দিন আহমদ। ১৯৭১ সালের ১২ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম আহসান আনুষ্ঠানিকভাবে 'জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়'-এর উদ্বোধন করেন। এর আগেই ৪ জানুয়ারি অর্থনীতি, ভূগোল, গণিত ও পরিসংখ্যান বিভাগে ক্লাস শুরু হয়। প্রথম ব্যাচে ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১৫০।
স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশনে ১৯৭৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয় অ্যাক্ট পাস করা হয়। এই অ্যাক্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম রাখা হয় 'জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়'। ৬৯৭ দশমিক ৫৬ একর ভূমির ওপর প্রতিষ্ঠিত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে পাঁচটি অনুষদের অধীনে ৩৩টি বিভাগ চালু আছে। এ ছাড়া ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি (আইআইটি), ইনস্টিটিউট অব বিজনেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইবিএ-জেইউ), বঙ্গবন্ধু তুলনামূলক সাহিত্য ও সংস্কৃতি ইনস্টিটিউট, ইনস্টিটিউট অব রিমোট সেন্সিং ও ভাষা শিক্ষা কেন্দ্র রয়েছে। আবাসিক হল ১৬টি। ছাত্রছাত্রী প্রায় ১৫ হাজার। বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এ পর্যন্ত পাঁচটি সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়েছে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের এ দীর্ঘ যাত্রায় অনেক মাইলফলক অর্জিত হয়েছে। দীপ্তিময় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তবুদ্ধি এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চার ঋদ্ধতায় দেশ-জাতির সমৃদ্ধ হওয়ার অনেক নজির আছে। ২০০১ সালের ১২ জানুয়ারি তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল বায়েস বিশ্ববিদ্যালয় দিবস পালনের প্রচলন করেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে উপাচার্য অধ্যাপক ড. আমিরুল ইসলাম চৌধুরী বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে ২৫ বছর পূর্তির রজতজয়ন্তী উদযাপন করেন।
স্মর্তব্য, একটি উচ্চতর গবেষণা প্রতিষ্ঠান হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়কে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রার প্রাক্কালে দেশের খ্যাতনামা শিক্ষকদের নিয়ে আসা হয়। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মধ্যে অনেকেই শিক্ষা ও গবেষণায় দেশে-বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কার লাভ করেছেন। সরকারের উপদেষ্টা, মন্ত্রী এবং সংসদ সদস্য হিসেবে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা রাষ্ট্র পরিচালনায় ভূমিকা রেখেছেন।
অজানা নয়, বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারি আমাদের সবকিছুকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। এ মহামারিতে পৃথিবীর প্রায় সর্বক্ষেত্র কম-বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং হচ্ছে। এর মধ্যে শিক্ষাক্ষেত্র অন্যতম। আবার এটাও সত্য, চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন অভিজ্ঞতা এবং সম্ভাবনার দ্বারও উন্মুক্ত হয়। সারাজীবন যে শিক্ষকরা প্রচলিত টিচিং-লার্নিংয়ে অভ্যস্ত, তারা সবাই অনলাইন বা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ক্লাস নেওয়া, ছাত্রছাত্রীদের মূল্যায়ন করার পদ্ধতি রপ্ত করেছেন। করোনায় শিক্ষাক্ষতি পুষিয়ে নিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সময়োপযোগী এবং বাস্তবসম্মত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যা দেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পথপ্রদর্শক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পাখিমেলা এবং প্রজাপতি মেলা দেশজুড়ে সমাদৃত। বাংলাদেশে এ দুটি মেলা এখানেই প্রথম চালু হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের আয়োজনে বিপন্নপ্রায় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্র এবং প্রজাপতি পার্ক স্থাপন করে জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবদান দেশ-বিদেশে প্রশংসা লাভ করেছে।
বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম দেশের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম নারী উপাচার্য। অধ্যাপক ড. রাশেদা আখতারকে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ দিয়ে সরকার নারীর ক্ষমতায়নে আরও একটি মাত্রা যোগ করেছে। রহিমা কানিজকে রেজিস্ট্রার হিসেবে দায়িত্ব দিয়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. ফারজানা ইসলাম নারীর ক্ষমতায়নের নতুন নজির স্থাপনে অংশীজন হয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ওয়াজেদ মিয়া বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্রে প্রাণিবিদ্যা বিভাগের গবেষণাগারে কীটপতঙ্গের জিনের বারকোডিং করা হচ্ছে, যা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রথম।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের 'সাংস্কৃতিক রাজধানী' বলা হয়। বর্তমান সরকার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকতর উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা অনুমোদন দিয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ছাত্রদের তিনটি এবং ছাত্রীদের তিনটি আবাসিক হল প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এ প্রকল্পের অধীনে অন্যান্য স্থাপনার কাজও শিগগির শুরু হচ্ছে। সুতরাং এ প্রকল্পের অধীনে বিভিন্ন স্থাপনার কাজ সম্পন্ন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবয়ব যে আমূল বদলে যাবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ড. আহমেদ সুমন :প্রাক্তন শিক্ষার্থী ও সাবেক সাধারণ সম্পাদক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি
মন্তব্য করুন