করোনা নিয়ন্ত্রণে সরকার সোমবার যে ১১ দফা বিধিনিষেধ জারি করেছে, তা নিঃসন্দেহে সময়োচিত পদক্ষেপ। করোনার নতুন ধরন 'ওমিক্রন' সংক্রমণ যেভাবে বেড়ে চলেছে, তাতে এর বিকল্প ছিল না। বস্তুত করোনা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতির আগেই আমরা এই সম্পাদকীয় স্তম্ভে বরাবরই কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের তাগিদ দিয়ে আসছিলাম। আমরা দেখেছি, নির্দেশনায় মাস্ক পরা কিংবা স্বাস্থ্যবিধি মানার ওপর যেমন কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে, তেমনি রেলসহ গণপরিবহনে অর্ধেক সংখ্যক আসন ফাঁকা রাখা, অনুষ্ঠান কিংবা সমাবেশ বন্ধের বিষয়টিও স্পষ্টভাবে এসেছে। আমরা মনে করি, শুধু নির্দেশনা জারি করলেই হবে না; এসব বিধিনিষেধ যথাযথভাবে বাস্তবায়নেও নজর দিতে হবে। একই সঙ্গে এই বিধিনিষেধ বাস্তবায়ন যেন নতুন কোনো সংকট তৈরি না করে সেটিও নিশ্চিত করা চাই।
আমাদের মনে আছে, গত বছর যখন সরকার করোনা নিয়ন্ত্রণে এ রকম বিধিনিষেধ আরোপ করে তখন বাস ভাড়া নিয়ে এক ধরনের নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়। এবারও ইতোমধ্যে ৫০ শতাংশ ভাড়া বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন বাস মালিকরা। গণপরিবহনের যাত্রী সংখ্যা অর্ধেক করলে ভাড়া বাড়তে পারে; কিন্তু সেটা ৫০ শতাংশ বৃদ্ধি করা যৌক্তিক হবে না। এমনিতেই গত বছরের শেষদিকে ডিজেলের দাম বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে বাস ও লঞ্চ ভাড়া উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়ানো হয়। যার প্রভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পাশাপাশি জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় সাধারণ মানুষের যে নাভিশ্বাস উঠছে, তা স্পষ্ট। এখন নতুন নির্দেশনার পর গণপরিবহনের ভাড়া বাড়ানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই সাধারণের বিষয়টি বিবেচনা করতে হবে। একই সঙ্গে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন কিংবা ভাড়া আদায় করছে কিনা, সেদিকেও দৃষ্টি দেওয়া চাই।
স্বাভাবিকভাবেই কয়েকটি নির্দেশনার সঙ্গে করোনা সুরক্ষা টিকার বিষয়টি যুক্ত। বিশেষ করে ১২ বছরের ঊর্ধ্বের সব শিক্ষার্থীকে এ মাসের মধ্যে সরকার টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। প্রায় পৌনে এক কোটি শিক্ষার্থীকে ৩১ জানুয়ারির মধ্যে টিকা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করা শিক্ষার স্বার্থেই জরুরি। কিন্তু সমকালের প্রতিবেদনে দেশের বিভিন্ন জায়গায় শিক্ষার্থীর টিকা পেতে ভোগান্তির যে চিত্র এসেছে, তা হতাশাজনক। আমরা মনে করি, শিক্ষার্থীদের টিকা নিবন্ধনের শর্ত শিথিল করা যেমন প্রয়োজন, একই সঙ্গে অব্যবস্থাপনা দূর করাও জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেন সুশৃঙ্খলভাবে টিকা নিতে পারে, সেটি নিশ্চিত করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সহায়তায় স্বাস্থ্য প্রশাসন আন্তরিকভাবে এগিয়ে আসবে বলে প্রত্যাশা। এর বাইরে হোটেল-রেস্তোরাঁসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে টিকার সনদ যেভাবে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে, সে ক্ষেত্রে আমরা বলব, কেউ যাতে অন্তত এক ডোজ সম্পন্ন করেই সেবা পেতে পারে- এমন ব্যবস্থা থাকা প্রয়োজন। তবে সেখানেও শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখাসহ স্বাস্থ্যবিধি মানার বিষয়টি ভুললে চলবে না।
করোনা সংক্রমণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসায়ও তার চাপ পড়ে। সোমবারের সমকালে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে চিকিৎসায় শঙ্কার বিষয়টি স্পষ্ট। আমাদের মনে আছে, গত বছর জুন-জুলাই মাসে প্রতিদিন গড়ে ১০ হাজারের ওপরে মানুষ আক্রান্ত হয়েছিলেন। তখন কিন্তু প্রয়োজন থাকার পরও সবাইকে হাসপাতালে ভর্তি করা সম্ভব হয়নি। এবারও পরিস্থিতি তেমন আকার ধারণ করলে স্বাস্থ্যসেবার ওপর চাপ তৈরি হতে পারে। সে জন্য আগে থেকেই যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া জরুরি। তবে পরিস্থিতি যাতে সে পর্যায়ে না গড়ায়, সে জন্য আরোপিত এসব বিধিনিষেধের কঠোর প্রয়োগে প্রশাসন ও জনগণ উভয়কেই আন্তরিক হতে হবে।
বিধিনিষেধ বাস্তবায়নে প্রশাসনের প্রয়োজনীয় কৌশলও নির্ধারণ করা চাই। বিধিনিষেধ মানা হচ্ছে কিনা, তা তদারকিতে ঘাটতি থাকা কাম্য নয়। আমরা মনে করি, করোনা নিয়ন্ত্রণ স্বাস্থ্য বিভাগের একার কাজ নয়। এর সঙ্গে যেসব মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যুক্ত রয়েছে, তাদেরও
তৎপর হওয়া চাই। আমরা প্রত্যাশা করি, মানুষকে সম্পৃক্ত করেই প্রশাসন করোনা নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব পালন করে যাবে। একই সঙ্গে টিকা দেওয়া অব্যাহত রাখার কাজটিও এখনকার অন্যতম অগ্রাধিকার হওয়া প্রয়োজন। আমরা বিশ্বাস করি, প্রত্যেকের দায়িত্বশীল আচরণের মাধ্যমে করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এমনিতেই দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিসহ
নানা কারণে মানুষ অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। তার ওপর যদি লকডাউনের মতো কর্মসূচি দেওয়া হয়, সেটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে দেখা দিতে পারে।

বিষয় : করোনা নিয়ন্ত্রণে বিধিনিষেধ

মন্তব্য করুন