ইসলামে নারীর উন্নত মর্যাদা স্বীকৃত। মানবেতিহাসের সর্বনিকৃষ্ট যুগ তথা আরবের 'আইয়ামে জাহেলিয়া'তে নারীর মর্যাদা ও অধিকার নিশ্চিত ছিল না। যেসব কারণে সেই যুগটি ইতিহাসে অন্ধকারের যুগ হিসেবে চিহ্নিত তার অন্যতম ছিল নারীর প্রতি অবমাননা। সে যুগে নারীদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের কোনো বালাই ছিল না। আর নারীর সম্মান ও মর্যাদা; তা ছিল সুদূরপরাহত। কন্যাসন্তানের জন্ম হওয়াকেই মনে করা হতো অপয়া, অলক্ষুণে ও মান-ইজ্জতের পরিপন্থি। নারীসমাজের জন্য এমনই এক বিভীষিকাময় অন্ধকারকে দূরীভূত করে নারীর প্রকৃত অবস্থান, উন্নত মর্যাদা আর সব অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করেছে ইসলাম। খ্রিষ্টীয় ষষ্ঠ-সপ্তম শতকে নারী জাতির বসবাসের অনুপযোগী সমাজব্যবস্থাকে ইসলামের শান্তি ও মানবতার বার্তা দিয়ে নারীদের জন্য চলমান সব অভিশপ্ততার মূলোৎপাটনপূর্বক এক আশীর্বাদময় সমাজের গোড়াপত্তন করা হয়; যেখানে কন্যা, স্ত্রী ও মা হিসেবে নারীর সর্বোন্নত মর্যাদা ও সব অধিকার সুনিশ্চিতকরণের বিষয়টি প্রাধান্য পায়। জন্মগ্রহণের অব্যবহিত পরেই যে নবজাতক কন্যাকে হত্যা করে জীবন্ত কবর দেওয়া হতো, সেই কন্যা ফিরে পেল তার মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকার সব অধিকার।
মরুময় আরবের অন্ধকার যুগ ভেদ করে ইসলামের আগমন ঘটে। মানবতার পরম সুহৃদ মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর ঘোষণা ছড়িয়ে পড়ে- 'তোমাদের মধ্যে যে ব্যক্তি কোনো কন্যাসন্তানের জনক হবে, সে সোজা আল্লাহর জান্নাতে চলে যাবে।' তাকে জিজ্ঞেস করা হয়, যদি পরপর দুটি কন্যা হয়? মমতাময় হৃদয় দিয়ে তিনি বলে দিলেন, যদি কারও দুটি কন্যাসন্তান হয় সেও জান্নাতে যাবে এবং যদি কারও পরপর তিনটি কন্যাসন্তান থাকে, সেও জান্নাতবাসী হবে। তদানীন্তন আরবে কন্যাসন্তান হলে তার পিতাকে লোকেরা নানা গালি দিত। কন্যার পিতাকে গালি দেওয়ার এই অপসংস্কৃতি আজকের আধুনিক যুগেও অনেক সমাজে দেখা যায়। মহানবী (সা.) অত্যন্ত কঠোরতার সঙ্গে এ ব্যাপারে সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন- 'তোমরা মেয়েসন্তানের পিতাকে গালি দেবে না, কারণ আমি নিজেই মেয়েদের পিতা।' উল্লেখ্য, প্রিয় নবী (সা.) নিজে চারটি মেয়েরত্নের গর্বিত পিতা ছিলেন। এই মেয়ে যখন বড় হয়ে ওঠে তখন তার বিয়ে হয়, সে হয় কারও স্ত্রী, বধূ। মহানবী (সা.) স্ত্রীর মর্যাদা ও অধিকার সম্বন্ধে সবাইকে সতর্ক করেছেন, সদুপদেশ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, তোমরা যা খাবে তাদেরও তা-ই খেতে দেবে; তোমরা যা পরবে তাদেরও তা-ই পরতে দেবে। বিদায় হজের ঐতিহাসিক ভাষণেও মহানবী (সা.) সবাইকে স্ত্রীদের ব্যাপারে সাবধান করেছেন। তাদের সব অধিকারের প্রতি যত্নশীল থাকতে বলেছেন। স্ত্রীদের সব ন্যায্যতা ও প্রাপ্যতা পরিশোধ-সংক্রান্ত নির্দেশনার ব্যাপারেও তিনি ছিলেন অনমনীয়। স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ভিত যেন মজবুত হয় সে জন্য তিনি ঘোষণা করেছেন- 'তোমাদের মধ্যে সে ব্যক্তিই উত্তম, যে তার স্ত্রীর কাছে উত্তম।' সুতরাং স্বামীর উৎকৃষ্টতার সনদ দেবে তার স্ত্রী। তাই কাউকে উত্তম মানুষের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে হলে স্ত্রীকেই ভাবতে হবে তার অনিবার্য অনুষঙ্গ হিসেবে। এ ক্ষেত্রে ইসলাম নারীকে স্বতন্ত্র মর্যাদা প্রদান করেছে। বাহ্যিকতার চাকচিক্যে কোনো ব্যক্তি যতই নিজেকে মহৎ দাবি করুক না কেন; সহধর্মিণী যদি তার ব্যাপারে ইতিবাচক ছাড়পত্র না দেয়, তবে তিনি নিশ্চিত ভণ্ড। কেননা, বিবাহিত কোনো পুরুষকে তার স্ত্রীর চাইতে ভালো আর কেউ জানে না। সে জন্যই মহানবী (সা.) ব্যক্তির উত্তম হওয়ার মানদণ্ড হিসেবে স্ত্রীর সনদকে প্রাধান্য দিয়েছেন, যা নারীর সম্মানকে বাড়িয়ে দেয়।
ইসলাম নারীকে তার ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিকসহ সর্বক্ষেত্রে যে অধিকার ও মর্যাদা দিয়েছে; আমাদের উচিত প্রকৃত অর্থেই তা সমুন্নত রাখা এবং সুরক্ষা করা। নারীর প্রতি কোনো রূপ বৈষম্য এবং নারীকে অসম্মান কোনোমতেই মানবিক ও মূল্যবোধের সংস্কৃতির পরিপূরক নয়; বরং 'অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর'। বিশ্ব সভ্যতার গোড়াপত্তনে নারীর যে সক্রিয় অংশগ্রহণ ও অবদান, তার প্রতি যথাযথ মূল্যায়ন ও গুরুত্ব প্রদান করে সামগ্রিক সৃষ্টিকে আরও অনুপম মাধুর্যে সৌন্দর্যমণ্ডিত করাই আমাদের পরম কর্তব্য।
অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বাহাউদ্দিন : চেয়ারম্যান, ফারসি ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

বিষয় : ইসলামে নারীর মর্যাদা

মন্তব্য করুন