- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- সহিংসতার দায় নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই
ইউপি নির্বাচন
সহিংসতার দায় নিতে হবে নির্বাচন কমিশনকেই

ইউপি নির্বাচনের পঞ্চম ধাপ শেষ হয়েছে ৫ জানুয়ারি। নির্বাচনের আরও কয়েক ধাপ বাকি। প্রথম থেকে পঞ্চম ধাপ পর্যন্ত আমরা দেখলাম অনেক মানুষ খুন হয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সমর্থক ও রাজনৈতিক সন্ত্রাসীদের হাতে। হামলায় ব্যবহূত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্রসহ নানা ধারালো অস্ত্র। যাকে বলে লঙ্কাকাণ্ড, সেই রকম রক্তাক্ত পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে চলমান ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে। গ্রামীণ জনপদের মানুষ এতটা সহিংস হয়ে উঠতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারিনি আগে। ভেতরে ভেতরে গ্রামগুলোকে রাজনৈতিকভাবে হানাহানিপ্রবণ করে তোলা হয়েছে। কে বা কারা এমনটি করেছে?
সম্প্রতি সংবাদমাধ্যমে 'নির্বাচন গণতান্ত্রিক পরিবেশে হয়নি' শিরোনামে প্রকাশিত খবরের কয়েকটি লাইন এ রকম- মানুষ দল বেঁধে ভোটকেন্দ্রে যেতেন। পছন্দের প্রার্থীকে বিজয়ী করতেন। এখন যাদের টাকা, সন্ত্রাসী বাহিনী ও পৃষ্ঠপোষক আছে, তাদের মনোনয়ন দেওয়া হয়। এতে সব ভোটার ভোট দিতে যান না। ৫ জানুয়ারি পঞ্চম ধাপে ভোটের দিনের সহিংসতায় নিহত হয়েছেন ১০ জন। ছিল জাল ভোট, ভোটকেন্দ্র দখলসহ নানা অভিযোগ। বিনা ভোটেও জয়ী হয়েছেন অনেকে। ইউপি নির্বাচন নিয়ে বগুড়া, ঝিনাইদহ ও কুমিল্লার তিন বিশিষ্টজনের অভিমত- জামানত হারাচ্ছেন নৌকার অনেক প্রার্থী। ১৫ লাখ টাকার চেক দিয়েও মনোনয়ন পাননি একজন নৌকার প্রার্থী। জামানত হারানো নৌকার প্রার্থীর সংখ্যা বাড়ছে। বিজয়ী অধিকাংশই বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থী। যে উৎসাহ-উদ্দীপনার কথা শোনা গেছে, এমন অভিযোগও সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে- আসলে তা নেই। ভোটার কিংবা জনগণের মধ্যে ইউপি নির্বাচন নিয়ে তেমন সাড়া নেই। টেলিভিশনে রাজনৈতিক এজেন্ট এবং অপতৎপরতার সহযোগী তাদেরকেই ভোটকেন্দ্রের চারদিকে বাঁশের লাঠিসহ বিভিন্নরকম অস্ত্রে সজ্জিত অবস্থায় দেখা গেছে। কিছু নির্দলীয় ইউপি চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী আগামী ধাপের নির্বাচনে দাবি করেছেন প্রতিটি কেন্দ্রে ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের। সন্ত্রাসী, সিলমারা পার্টি, জাল ভোটসহ সব রকম নেতিবাচকতা থামাতেই তারা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগের দাবি করেছেন।
এ থেকেই ইউপি নির্বাচনের গোটা পরিস্থিতি আমরা সম্যক উপলব্ধি করতে পারছি, দেশের সাধারণ মানুষও তা বুঝতে পারছেন। আর যেসব এলাকায় স্থানীয় সরকারের ইউপি নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে, তারা নির্বাচনের আনন্দকে ধরে রাখতে পারেননি সন্ত্রাসীদের অপতৎপরতায়। মানুষ হত্যার বেদনায় তারা কেবল মর্মাহতই নন, এসব নির্বাচনী তৎপরতার মাশুল তাদের গুনতে হচ্ছে নানাভাবে। আমরা এর মধ্যেই শুনেছি, বিদ্রোহী প্রার্থী ও নৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর প্রতি অনুগত বা তাদের জন্য ভোটের মিছিলে যোগ দিলেই তাদের দল থেকে বহিস্কারের হুমকি দেওয়া হয়েছে। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়েছেন বিএনপির একজন নেতা। তাকে এর মধ্যেই দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছে। বর্তমান মেয়র ডা. আইভীর বিরুদ্ধে যারা নির্বাচনী প্রচারণায় নেমেছেন বা আইভির প্রচারণায় যোগ দিচ্ছেন না, এ কারণে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি বাতিল করা হয়েছে।
শান্তিপ্রিয়দের প্রত্যাশা, সাধারণ মানুষ যেন কোনোরকম ভয়ভীতি ছাড়াই নির্বিঘ্নে তাদের ভোট দিতে পারেন- সে রকম পরিবেশ নিশ্চিত করা হোক। এটাই ছিল জরুরি কাজ। নির্বাচনের সময় নির্বাচন করার লক্ষ্যে সব দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত থাকে। কিন্তু সিইসি এ কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, 'ওইসব হত্যাকাণ্ডের দায় প্রার্থীদের; কমিশনের নয়। কারণ, প্রার্থীদের উদগ্র বাসনায় বিজয় অর্জনের পথে ওইসব হত্যার ঘটনা ঘটেছে।' নির্বাচনের সময় যেহেতু প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে- আমাদের বক্তব্য সেহেতু দায় কমিশনেরই; প্রার্থীদের নয়। নির্বাচন কমিশন দায় এড়াতে পারে না। আবার এটাও মনে রাখতে হবে, যারা জনপ্রতিনিধি হতে যাচ্ছেন, তারা সন্ত্রাসী দিয়ে জাল ভোট কেটে বিজয়ী হতে পারেন না। তাদের এই জোর যার মুলল্গুক তার মানসিকতা প্রকৃত গণতান্ত্রিক চেতনাকে তছনছ করে দিচ্ছে। ভোটে জেতার এই হীন মানসিকতা থেকে বোঝা যাচ্ছে, জনগণের সেবা নয়; তারা ক্ষমতায় যেতে চান, যাতে টু-পাইস কামানো যায়।
সরকার চেষ্টা করছে পুলিশের সাহায্যে নির্বাচনী পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে। কিন্তু সরকার নানা রাজনৈতিক চাপে আছে। খালেদা জিয়ার মুক্তি বিষয়ে সরকারের অবস্থান দুর্বল এবং আইন বিষয়ে আইনমন্ত্রীর ব্যাখ্যায় সাধারণ মানুষ খুশি নয়। কারণ, মানুষ জানে, নাগরিকের সাংবিধানিক অধিকার আছে বেঁচে থাকার। খালেদা জিয়াকে সঠিক চিকিৎসার জন্য বিদেশে যেতে হবেই। কারণ দেশে সে রকম চিকিৎসা ব্যবস্থা নেই। তিনবারের প্রধানমন্ত্রী বলেই নয়; যে কোনো নাগরিকের সে অধিকার আছে ভিনদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়ার। খালেদা জিয়া কনভিকটেড আসামি বলেই যে তাকে বিদেশে চিকিৎসার জন্য যেতে দেওয়া বেআইনি হবে- এ যুক্তি সংবিধান অনুমোদন করে কিনা, সেটা দেখতে হবে। মানুষ মনে করে, তার সুচিকিৎসা পাওয়ার অধিকার রাষ্ট্রকে নিশ্চিত করতে হবে। সে দায়িত্ব সরকারের। আর সরকার সেই দায়িত্ব পালন না করলে, যে শপথ নিয়েছিল, সেই শপথ ভেঙে যায়। সরকার কি শপথ ভেঙে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করবে, নাকি দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের প্রতি একই রকম আরচণ করবে বলে যে শপথ বাক্য উচ্চারণ করে ক্ষমতায় গেছে, সেই শপথের মর্যাদায় অটল থাকবে?
রাজনীতি ও গণতন্ত্রের ঔজ্জ্বল্য ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা। সংবিধান মোতাবেক আইন করে নির্বাচন কমিশন গঠনের কোনো বিকল্প পন্থা দিয়ে ওই সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিয়ে রাষ্ট্রপতি যে সার্চ কমিটি গড়বেন এবং সেই কমিটিতে যারা যুক্ত হবেন, তারা রাজনৈতিক সরকারেরই আরেকজন কে এম নূরুল হুদা হতে বাধ্য- এ কথা বলে দুর্মুখরা। এ রকম নির্বাচন কমিশন সৃজনের স্বপ্ন কী করে সরকার চাইতে পারে, তা গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের বুঝে আসে না। গণতন্ত্র শাক্তিশালী হলে মাঠস্তরের নির্বাচনে এমন হানাহানি, রক্তাক্ত পরিণতি দেখতে হবে না। দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে গণতান্ত্রিক রীতিনীতি-বিধিবিধানের কোনো চর্চা নেই- এই সত্য যতদিন লালিত হবে, ততই আমরা অন্ধকারে নিমজ্জিত হতে থাকব। এ থেকে বের হয়ে আসতে হবে। তা না হলে বাড়তে থাকবে রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবধান। কোনোভাবেই সম্পদ যেন কুক্ষিগত না হয় কিছু মানুষের ঝুড়িতে। গরিবের হাঁড়ি-পাতিল হয়ে পড়ছে শূন্য। এমনটি আমরা চাইতে পারি না। আমরা চাই সমতা। সম্পদ বণ্টনে যেন প্রত্যেক মানুষ সেই সমতা পায়। অর্থনৈতিকভাবে যেন ধনী-গরিবের ব্যবধান আকাশ-পাতাল না হয়।
সাংবাদিক নির্মল সেন দৈনিক বাংলায় তার কলামে লিখেছিলেন- 'স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি চাই'। আমরা কি সেই স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি পেয়েছি?
ড. মাহবুব হাসান: কবি ও সাংবাদিক
মন্তব্য করুন