সম্প্রতি আটটি দেশের ৯টি সংস্থা গবেষণা চালিয়ে তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, বাংলাদেশের শহরগুলোতে ধর্ম, উপার্জনের সক্ষমতা, সুযোগ-সুবিধাসহ নানা বিষয় ঘিরে গত এক দশকে তাদের ভাষায় আশঙ্কাজনক বিভাজন লক্ষ্য করা গেছে। তারা বলেছে, মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য বাড়ছে।
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে বৈষম্য নিয়ে নানারকম কথা হয়ে থাকে। বৈষম্য কমবেশি সব সমাজেই বিদ্যমান এবং কোনো কোনো দেশে বৈষম্য উন্নয়ন-অগ্রগতি সত্ত্বেও মানুষে মানুষে ব্যবধান-বিভাজন প্রকট করে রেখেছে। এই প্রেক্ষাপটে পরিস্থিতি পর্যালোচনাক্রমে বলা যায়, অনেক দেশের তুলনায় আমাদের এখানে বৈষম্য কম। তবে এও সত্য, দিন দিন বৈষম্য বাড়ছে। আমরা জানি, সভ্যতার ভিত্তি হলো সাম্য। দার্শনিক, সমাজ-চিন্তকরা সবসময় দেখেছেন সাম্যের স্বপ্ন। সাধারণ কৃষক, শ্রমিক তাদের শ্রম দিয়ে যে সম্পদ সৃষ্টি করেছেন, সেই সম্পদ সব সময়ই, সব কালেই বলা চলে কিছু লোকের হাতে কুক্ষিগত হয়েছে।
সমাজ ও রাষ্ট্রে কিছু লোকের হাতে যখন সম্পদ কুক্ষিগত হয়, অর্থাৎ বেশিরভাগ মানুষ যখন ক্ষমতা ও সম্পদবঞ্চিত হয়, তখন এর বিরূপ প্রভাব হয় বহুমুখী। এটা শুধু আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটেই নয়, সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। দেখা যায়, রাষ্ট্র ওই নগণ্য সংখ্যকের সম্পদই রক্ষা করে। প্রাক রাষ্ট্র-সমাজে যাকে বলা হয়, প্রাচীন গোষ্ঠী বা উপজাতীয় সমাজ, সেখানে আমরা খুব বিভাজন-বৈষম্য দেখি না। সবার মধ্যে কমবেশি ভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত ছিল। সেখানে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল না, তাও কিন্তু নয়। তারপরও এক ধরনের ভ্রাতৃত্ববোধ ছিল, যা আমরা বর্তমানেও স্মরণ করি। গ্রিসের পর যখন অন্য সমাজেও সভ্যতার উন্মেষ ঘটে, অর্থাৎ গ্রেট ব্রিটেন থেকে পারস্য পর্যন্ত বিশাল রোমান সাম্রাজ্যেও দেখা গেছে দাস প্রথা। আমাদের এখানে আদিতে কৃষক সমাজ ছিল সংঘবদ্ধ এবং এই সমাজের পরিসরও ছিল বিস্তৃত। অনেক আগে থেকেই এই সমাজ গড়ে ওঠা শুরু হয়। কিন্তু সেই সমাজেও নানা রকম বৈষম্য ছিল। গ্রামে যে সম্পদ সৃষ্টি হতো, তা চলে যেত তৎকালে আমরা যাদের দ্বারা শাসিত ছিলাম তাদের কাছে।
প্রাচীন ভারতে বর্ণ প্রথাও দেখা গেছে, যা মানুষে মানুষে বিভাজন-বৈষম্য আরও বাড়িয়ে ছিল। কিন্তু তার মধ্যে এক ধরনের গণতন্ত্রও ছিল। কোনো কোনো পণ্ডিত তখন 'ভিলেজ রিপাবলিক' ব্যবস্থার কথাও বলেছেন। যখন পুঁজিবাদী গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে বিভিন্ন দেশে এবং সমগ্র বিশ্বকে নিয়ে আসে তাদের নিয়ন্ত্রণে, তখন আবার দেখা যায় অন্যরকম চিত্র। নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ এগিয়েছে। ব্রিটিশরা আমাদের সম্পদ লুণ্ঠন করেছে। দেশ বিভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নির্মম শোষণের বিরুদ্ধে ঘটতে থাকে গণজাগরণ। অথচ আনুপাতিক হারে পূর্ব পাকিস্তানে জনসংখ্যার হার বেশি ছিল।
এই প্রেক্ষাপটেই আমরা পাই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ছয় দফা, যা বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে স্বীকৃত। ছয় দফার ওই দাবিগুলো তারা মেনে নেয়নি এবং অনিবার্যভাবে ধাপে ধাপে যে আন্দোলন-সংগ্রামের অধ্যায় রচিত হলো, এরই ফসল এই বাংলাদেশ। ২০২১ সালে এসেও একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত দেশে বৈষম্য ও বিভাজন কাঙ্ক্ষিত ছিল না। তবে বিগত কয়েক দশকে আমাদের অর্জন কম তা বলা যাবে না। নানা সূচকে আমরা বিশ্বের এমনকি ভারত-পাকিস্তানের চেয়েও কোনো কোনো ক্ষেত্রে এগিয়ে আছি। তার পরও আমরা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা এখনও গড়ে তুলতে পারিনি। বিগত ৫০ বছরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সময় অপশাসনের কবলে থাকতে হয় পঁচাত্তরের মর্মন্তুদ অধ্যায়ের পর। সে পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পেয়ে যে সময় আমরা পার করেছি, তা কিন্তু খুব দীর্ঘ নয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে খুব কম সময়ে বঙ্গবন্ধু যে শাসনতন্ত্র মাত্র ১০ মাসে দিয়েছিলেন, তাতে প্রতিফলন ঘটেছিল মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়ের। কিন্তু সপরিবারে তাকে হত্যার পর শুরু হয় সেই সংবিধানে তৎকালীন স্বার্থান্বেষী কুচক্রী শাসক মহলের স্বার্থে দফায় দফায় কাটাছেঁড়া। বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, 'শোষকের নয়, আমরা এমন গণতন্ত্র চাই যা হবে শোষিতের গণতন্ত্র।' লক্ষ্য করার বিষয়, বিশ্বে আমরা অনেক রকম গণতন্ত্র দেখছি, যেখানে প্রধান লক্ষ্য হলো শুধু ভোট। সেই গণতন্ত্রের ভোটে নানাভাবে কেনাবেচা চলে এবং মুষ্টিমেয় লোকের হাতে পুঞ্জীভূত অর্থ শ্রেণিটিকে আরও পুষ্ট করে। দেশে আজকের উন্নতি-অগ্রগতি কিংবা সম্পদ সৃষ্টির পেছনে বড় অবদান সাধারণ মানুষের, কিন্তু ভোগের ক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে।
একাত্তরের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে উল্লিখিত তিনটি মূল স্তম্ভ- সাম্য, মানবিক মার্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচারের সামাজিক সাম্য নিশ্চিত করা যেতে পারে। গত ৫০ বছরে আমরা সমতাভিত্তিক, মানবিক মর্যাদাসম্পন্ন, জনআকাঙ্ক্ষার গণতান্ত্রিক নাগরিক রাষ্ট্র হিসেবে কতটা এগিয়েছি, সেই প্রশ্ন ওঠে। কিন্তু মনে রাখা দরকার, আমরা যদি ৫০ বছর আমলে নিয়ে সাফল্যের সবকিছু সন্ধান করি, তা ঠিক হবে না। গত এক দশকেরও বেশি সময়ে আমাদের অবকাঠামোগত, অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ নানা সূচকে যে অগ্রগতি হয়েছে,তাও মূল্যায়নের দাবি রাখে। যে দারিদ্র্য কমতে শুরু করেছিল, করোনাক্রান্তি তা আবার বাড়িয়ে তুলছে। সরকারের নানা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে। মানুষও বৈরী পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে সংগ্রাম করছে। জনবান্ধব কর্মসূচির ফলে আমাদের সম্পদের সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মানুষ পথে বসেনি- এই সত্য স্বীকার করতে হবে। শুধু রাজনৈতিক সমালোচনার জন্য সমালোচনা না করে ব্যর্থতার দায় দায়িত্বশীল সবারই কমবেশি নিতে হবে।
আমরা যে মানবিক, সমতাভিত্তিক সমাজের স্বপ্ন দেখি, তা তো শুধু সরকারের একক প্রচেষ্টায় নিশ্চিত করা যাবে না। রাষ্ট্র পরিচালকরা যদি বৈরী পরিস্থিতির মধ্যে থাকেন, তাহলে যে কোনো সরকারের পক্ষেই সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব পালন দুরূহ। তবে সবার যাতে গণতান্ত্রিক অধিকার সমুন্নত থাকে, তা নিশ্চিত করার ওপর জোর দিতে ভুল করা সমীচীন নয়। সুবিধাভোগী, পক্ষপাতদুষ্ট শ্রেণির কথা তো বঙ্গবন্ধু সেই কবেই বলেছিলেন। আমরা আজও তাদের অপছায়া দেখি নানা ক্ষেত্রে, নানাভাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদিচ্ছা কিংবা আন্তরিকতায় পুঞ্জীভূত সমস্যার নিরসন ঘটবে না যদি সরকারপ্রধানের সব সহযোগী শক্তি দায়িত্ব পালনে নিষ্ঠ না থাকে এবং বিরোধী পক্ষ যদি গঠনমূলক রাজনীতির পথ অনুসরণ না করে।
বৈষম্য যে কোনো সমাজের অন্যতম ব্যাধি। এই ব্যাধির নিরসন জরুরি সামগ্রিক প্রয়োজনেই। মানবিক মর্যাদা ব্যক্তির নাগরিক অধিকার ও রাজনৈতিক অধিকারের সঙ্গে সম্পর্কিত- এই সত্যও এড়ানো যাবে না। একটি সমতাভিত্তিক সমাজে রূপান্তরের আকাঙ্ক্ষা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোয় স্বচ্ছতা-জবাবদিহি নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে কাঙ্ক্ষিত স্তরে পৌঁছতে হলে সম্পদের সুষম বণ্টনও নিশ্চিত করা চাই। জবাবদিহিহীন কিছু লোকের ফুলে-ফেঁপে ওঠার রাস্তা রুদ্ধ করে বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য কল্যাণকর সব পথ কণ্টকমুক্ত করতে দেশপ্রেমিক ও গণতান্ত্রিক সব শক্তির যূথবদ্ধ প্রয়াস খুব জরুরি। শিক্ষা, স্বাস্থ্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতে দৃষ্টি গভীর ও এর সুফলভোগী যাতে সবাই হতে পারে, সে চেষ্টা যত নিবিড় হবে, এর সুফল সমাজে প্রতিভাত হবে।
সমতাভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে প্রয়োজন নতুন ও বৈচিত্র্যময় সৃজনশীল চিন্তা, নীতি ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা। আমাদের সম্ভাবনাময় যুবসমাজের মেধা-মনন-সৃজনশীলতা কাজে লাগিয়ে শুধু বৈষম্যের নিরসনই নয়, কল্যাণকামী সবকিছু নিশ্চিত করতে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে সামনে এগোতে হবে একাত্তরের অঙ্গীকার-প্রত্যয় ধারণ করেই। সম্পদ ও অর্থনৈতিক সুফল এবং সুযোগ-সুবিধা সর্বজনের কাছে পৌঁছানোর পথ মসৃণ করার বিকল্প নেই। ক্ষমতাহীন, দরিদ্র, পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে রাজনীতির দাবার ঘুঁটি না বানিয়ে তাদের কল্যাণে ব্রতী হওয়ার দায় সমাজের অন্যান্য শক্তিরও রয়েছে। বৈষম্যের ছায়া শুধু কথায় তো সরবে না। বৈষম্যের কারণগুলো অচিহ্নিত নয়। মানুষের অধিকার নিশ্চিত হলে বৈষম্যের ছায়া সরতে বাধ্য। ১৯৭১ সালে ৬০ শতাংশ মানুষের বসবাস ছিল দারিদ্র্যসীমার নিচে। বর্তমানে তা এসেছে ২০ শতাংশে মতান্তরে ২৫-এর ওপরে। তারপরও এই সংখ্যা অনেকই বলব। চরম দারিদ্র্যসীমার নিচেও রয়েছেন অনেকে। তারা যতক্ষণ পর্যন্ত না মর্যাদাপূর্ণ জীবন পাচ্ছেন; স্বাস্থ্য-শিক্ষা-অবকাশ ও সংস্কৃতিবদ্ধ জীবনাধিকার হচ্ছেন, ততদিন পর্যন্ত আমাদের কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাব কী করে? বিদ্যমান বৈষম্য নিরসনে সরকার তো বটেই, একই সঙ্গে রাজনৈতিক মহল, বিদগ্ধ সমাজসহ দায়িত্বশীল সব মহলকে অবশ্যই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। আরও একটি জরুরি বিষয় হলো, গণতন্ত্র যত বিকশিত হবে, অধিকারের পথও তত মসৃণ হবে।
ড. অনুপম সেন: সমাজবিজ্ঞানী; প্রাক্তন অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়