সাহিত্যে ২০২১-এর নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন আবদুলরাজাক গুরনাহ। ৭৩ বছর বয়সী তানজানিয়ার এ কথাসাহিত্যিককে এ পুরস্কার দেওয়া হয়েছে ঔপনিবেশিকতার অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে তার আপসহীন সংগ্রাম এবং সংস্কৃতি ও মহাদেশীয় পরিসরে উদ্বাস্তু মানুষের কণ্ঠস্বরকে সাহসের সঙ্গে তুলে ধরার জন্য। তিনি আপসহীনভাবেই লিখে চলেছেন শিকড়হীন মানুষের বেদনার কথা। আবদুলরাজাকের জন্ম ১৯৪৮ সালে পূর্ব আফ্রিকার জাঞ্জিবারে। ১৯৬০-এর দশকে তিনি পূর্ব আফ্রিকা থেকে উদ্বাস্তু হিসেবে ইংল্যান্ডে যান। ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকতা থেকে জাঞ্জিবার মুক্ত হয়। কিন্তু সে সময় সেদেশে শুরু হয় আরব-বংশোদ্ভূতদের বিরুদ্ধে অত্যাচার ও গণহত্যা। আবদুলরাজাক ও তার পরিবার আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে পড়লে তাদের বাধ্য হয়ে দেশ ছেড়ে উদ্বাস্তুর খাতায় নাম লেখাতে হয়। ১৯৮৪ সালের আগে তিনি আর স্বভূমিতে ফিরে যেতে পারেননি। ভূমিচ্যুত হওয়ার বেদনা তাকে উত্তর-ঔপনিবেশিকতাবাদের দিকে দৃষ্টি প্রসারিত করতে বাধ্য করে। পরবর্তীকালে তিনি ক্যান্টারবেরির ইউনিভার্সিটি অব কেন্টে ইংরেজি এবং উত্তর-ঔপনিবেশিক সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে কাজ শুরু করেন। সালমান রুশদি, গুগি ওয়া থিয়াংগোর মতো লেখকদের সাহিত্য বিষয়ে তিনি পাঠদান করেন। পাশাপাশি নিজেও হাতে কলম ধরেন ভূমিচ্যুত মানুষের বেদনা এবং ফেলে আসা দেশের স্মৃতি ও সত্তাকে তুলে ধরার স্বার্থে। তার লেখায় বিশেষভাবে স্থান পায় উপনিবেশ-উত্তর চৈতন্য এবং ভাবনা। ২০০৫ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'ডেসারশন'-এ তিনি এমন এক প্রেমকে তুলে ধরেন, যা তার ভাষায় 'সাম্রাজ্যবাদী রোম্যান্স'-এর একেবারে বিপরীত মেরুতে অবস্থান করে। তিনি লিখেছেন দীর্ঘদিন ধরে চলা দাসপ্রথার কথা, ভারত মহাসাগরের দ্বীপভূমিগুলোর আকাশে ঘনিয়ে থাকা পরস্পরবিরোধী সাংস্কৃতিক মেঘের কথা। তিনি শক্ত করে দেখাতে চেয়েছেন, তথাকথিত বিশ্বায়নের অনেক আগেই ভারত মহাসাগরে বাণিজ্য ও রাজনীতি জাঞ্জিবারের মতো দ্বীপভূমিতে বহুমাত্রিক সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল।

১৯৮৭ সালে তার প্রথম উপন্যাস 'মেমোরি অব ডিপার্চার'-এ তিনি তৃতীয় বিশ্বের বিপ্লব-স্বপ্নের ভাঙা রেকর্ডকে তুলে ধরেছিলেন, যার সাক্ষী করেছিলেন এশিয়া ও আফ্রিকার অগণিত দেশের সঙ্গে ভারতকেও। কিন্তু তাকে বিশ্বখ্যাতি এনে দেয় ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত উপন্যাস 'প্যারাডাইস'। প্যারাডাইসে তিনি পুরাণকথার সঙ্গে মিলন ঘটাতে চেষ্টা করেন সাম্প্রতিকের। ১৯৯৪ সালে বুকার পুরস্কার জিতেছিল প্যারাডাইস। তার ১৯৯৬-এর উপন্যাস 'অ্যাডমায়ারিং সাইলেন্স' এবং ২০০১-এর 'বাই দ্য সি'তে তিনি নীরবতাকে ভূমিচ্যুত মানুষের এক বড় অস্ত্র হিসেবে তুলে ধরেন। তার সর্বশেষ উপন্যাস 'আফটার লাইভস' প্রকাশিত হয়েছে ২০২০-এ। এ পর্যন্ত ১০টি উপন্যাস ও একটি ছোট গল্পের সংকলন প্রকাশিত হয়েছে আবদুলরাজাকের। উদ্বাস্তু জীবনের আয়না হাতে এক ছিন্নমূলের বৃত্তান্ত তৈরি করে নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নিলেন পূর্ব আফ্রিকার এ কথাসাহিত্যিক। তিনি বিশ্বাস করেন, মানুষ স্মৃতি দিয়েই তৈরি হয়। স্মৃতিই তার সত্য, তার সত্তা। বিশ শতকের পূর্ব আফ্রিকার রক্তাক্ত ইতিহাস যারা জানেন, তাদের কাছে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে তার উপন্যাস 'আফটার লাইভস'। এ উপন্যাসের ব্যাপ্তি ১৯০৪ সালের নামিবিয়ায় সংঘটিত নামা ও হেরেরো গণঅভ্যুত্থান থেকে ১৯০৭-এর মাঝামাঝি আন্দোলন পর্যন্ত।

এবারের সাহিত্যে সম্ভাব্য নোবেল বিজেতার নামের তালিকায় ছিল অনেক প্রথিতযশা সাহিত্যিকের নাম। হারুকি মুরাকামি, ওয়া থিয়েংগো, লুডমিলা উলিত-স্কায়াসহ আরও কত নাম! কিন্তু সব সম্ভাবনা আর প্রত্যাশাকে ম্লান করে শেষ পর্যন্ত নোবেল পুরস্কার ছিনিয়ে নিলেন একজন আবদুলরাজাক, যিনি তানজানিয়ার প্রথম মানুষ- এ সম্মান পেলেন। তার এমন কোনো লেখা নেই যেখানে আসেনি উত্তর-ঔপনিবেশিকতা এবং ছিন্নমূল মানুষের অনুষঙ্গ। নোবেল কমিটি জানিয়েছে, উপসাগরীয় অঞ্চলের শরণার্থীদের ওপর ঔপনিবেশিকতার প্রভাব কীভাবে তাদের ভাগ্যকে প্রভাবিত করে; বিশ্বসাহিত্যের সামনে তা-ই তুলে ধরেছে গুরনাহর লেখনী।

সুধীর সাহা: কলাম লেখক