যেকোনো আন্দোলনে পুরুষের পাশাপাশি সব সময় এগিয়ে গেছেন নারীরা। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের ভূমিকা ছিল অনন্য। তবুও নারীর এই অবদান কিছুটা আড়ালে থেকে গেছে বরাবর।

ভাষা আন্দোলন ১৯৪৭ থেকে ১৯৫৬ পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব বাংলার একটি সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলাকে ইসলামীকরণের অংশ হিসেবে ঘোষণা করে-উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। পাশাপাশি বিকল্প হিসেবে আরবি হরফে বাংলা লিখন অথবা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা আরবি করারও প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ঘোষণায় পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী জনগণের মধ্যে গভীর ক্ষোভের সৃষ্টি হয় ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পূর্ব বাংলার বাংলাভাষী মানুষ এ সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেনি। ফলে বাংলা ভাষার সমমর্যাদার দাবিতে পূর্ব বাংলায় আন্দোলন দ্রুত দানা বেঁধে ওঠে। আর স্বভাবতই একটি আন্দোলনে অনেকের একাত্মতা প্রয়োজন। ছাত্রছাত্রীরা বিষয়টি অনুধাবন করেন। কিন্তু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন ছাত্রী সংখ্য ১০০-এরও কম। তাই ছাত্রীদের ওপর প্রথম দায়িত্ব পড়ে ছাত্রী সংগ্রহ করার।

৩১ জানুয়ারি ১৯৪৮ ঢাকার বার লাইব্রেরিতে সর্বদলীয় সভায় ছাত্রীদের পক্ষ থেকে ইডেন কলেজের ছাত্রী মাহবুবা খাতুন বলেন, 'বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি স্বীকার করিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হলে মেয়েরা তাদের রক্ত বিসর্জন দেবে। ১১ মার্চ ভোরবেলায় শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন ভবন ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করেন। সকাল ৮টায় পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ করলে কয়েকজন ছাত্রী বাধা দিতে গেলে পুলিশের লাঠিপেটার শিকার হন। ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত অনেককে জেলে নিয়ে যায়। যে পাঁচ দিন ছাত্ররা জেলে ছিলেন; সকাল ১০টায় স্কুলের মেয়েরা মুসলিম গার্লস স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দেওয়া শুরু করতেন। চলত বিকেল ৪টা পর্যন্ত।'

১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি হলে নারী ভাষাসংগ্রামীরা এর পক্ষে মত দেন। সেদিন সকাল থেকেই স্কুল-কলেজের মেয়েরা ছোট ছোট দলে এসে আমতলার সভায় যোগ দেন। নারী ভাষাসংগ্রামীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলন দমাতে পুলিশের জারি করা ১৪৪ ধারা প্রথমেই ভেঙে দিতে সক্ষম হন। ১০ জন করে বের হওয়া প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। ছাত্ররা ব্যারিকেডের ওপর ও নিচ দিয়ে লাফিয়ে চলে যান। পরে তৃতীয় দল নিয়ে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানি শুরু করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ আর টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন।

২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ গায়েবানা জানাজা, শোক মিছিল ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতালসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এক সারিতে ছিলেন সব মিছিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে পোস্টার এঁকেছেন। আহতদের চিকিৎসায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আন্দোলনকে বেগবান করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন নারীরা। অনেক গৃহিণী আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে নিজের গহনা খুলে দেন। ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় অনেক নারীকে জেলে যেতে হয়। অনেক ছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কৃত হন। শুধু ঢাকাতেই নয়; ঢাকার বাইরেও নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারাও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন।

১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা শহীদ মিনার গড়ে তোলেন। ১৯৫৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ বেদিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হতে পারে; তাই ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। সেদিন ঘটে আরও এক অনন্য ঘটনা। ছাত্রদের সঙ্গে ছাত্রীরাও ১৪৪ ধারা ভেঙে রাজপথে নেমে এলে ২০-২২ জন ছাত্রীকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। ওই গ্রেপ্তারের ঘটনায় জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে এবং সরকারের টনক নড়ে। পরের বছরই বাংলাকে পাকিস্তানের সংবিধানে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।

সুপা সাদিয়া: গবেষক, লেখক ও সংগঠক