সমকালীন প্রসঙ্গ
বাংলাদেশের ওপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব
দেলোয়ার হোসেন
প্রকাশ: ৩১ মার্চ ২০২২ | ১২:০০
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে এরই মধ্যে সামরিক ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি স্ম্ফীত হয়ে উঠছে। সামরিক-বেসামরিক মানুষের লাশের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি বাড়ছে বাস্তুচ্যুত ইউক্রেনীয়র সংখ্যা। বলা বাহুল্য, এ যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে গোটা ইউরোপে এক ধরনের নাড়া ও সাড়া পড়েছে। বিশ্নেষক, রাজনীতিবিদসহ অনেকেই একে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা বলে অভিহিত করেছেন। আমরা দেখেছি, পশ্চিমারা রাশিয়ার ওপর একের পর এক কঠিন অবরোধ আরোপ করেছে। এ যুদ্ধ স্বাভাবিক ক্ষয়ক্ষতির পাশাপাশি বৈশ্বিক রাজনীতিতে এক নতুন যুগেরও সৃষ্টি করেছে। একদিকে পশ্চিমাদের জোটবদ্ধ হওয়া, অন্যদিকে রাশিয়ার দৃঢ়তার সঙ্গে যুদ্ধে নামার মানে হলো নতুন শীতল যুদ্ধ শুরু হওয়া; যেটা আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেখেছি।
এ কারণেই বিষয়টি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব যেমন সরাসরি বাংলাদেশের ওপর পড়তে পারে, তেমনি বাংলাদেশের স্বার্থ বিবেচনায় পরোক্ষভাবেও আমাদের প্রভাবিত করতে পারে। বস্তুত বিশ্বায়নের এ যুগে দুটি দেশের মধ্যকার যুদ্ধ কেবল সংশ্নিষ্ট দেশগুলোর মধ্যে সীমিত থাকে না; বরং অন্যরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং বৈশ্বিক অর্থনীতিতে তার প্রভাব পড়তে বাধ্য। বাংলাদেশ তার বাইরে নয়। বলা বাহুল্য, বৈশ্বিক সম্প্রদায়ের সক্রিয় সদস্য হিসেবে বাংলাদেশ আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক যে কোনো বিষয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই বাংলাদেশের ওপর যুদ্ধের প্রভাব পড়বে তৎক্ষণাৎ এবং স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে।
ইউক্রেনে হামলার পরপরই বাংলাদেশ সরকার সে দেশে বসবাসরত প্রায় দুই হাজার বাংলাদেশির মধ্যে যারা দেশে ফেরত আসতে চান, তাদের আনতে উদ্যোগ নেয়। এরই মধ্যে ইউক্রেনে আটকে পড়া বাংলাদেশি জাহাজ 'এমভি বাংলার সমৃদ্ধি'র ২৮ নাবিক দেশে ফিরেছেন। রুশ হামলায় নিহত নাবিক হাদিসুর রহমানের মরদেহও সরকারের উদ্যোগে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
বস্তুত ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা বাংলাদেশকে দোটানায় ফেলে দিয়েছে। আপাতদৃষ্টিতে রাশিয়া একটি স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের ওপর যেভাবে হামলা করেছে, তা নিন্দার্হ। আমরা দেখেছি, এ মাসের শুরুতে ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের নিন্দা জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করেছে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ। প্রস্তাবে রাশিয়াকে অবিলম্বে ইউক্রেন থেকে সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানানো হয়েছে। জরুরি অধিবেশনে পাস হওয়া ওই প্রস্তাবে ভোটদানে বিরত ছিল ইরান, বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানসহ ৩৫ দেশ। যদিও সম্প্রতি এমন আরেকটি প্রস্তাবে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দিয়েছে বাংলাদেশ। ইউক্রেনে মানবিক সংকট নিরসনে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে উত্থাপিত প্রস্তাবের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দেওয়ার দু'দিন পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মানবিক কারণেই তারা এর পক্ষে ভোট দিয়েছেন। এ থেকে অনেকে যদিও বলছেন, ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশের নীতিগত অবস্থানের পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু আমি মনে করি, এটি কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত এবং এটি বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির আলোকে কোনোদিকে না ঝুঁকে একটা ভারসাম্য তৈরি করেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমাদের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার কারণে বিশ্ব-অর্থনীতি ভালো অবস্থানে নেই। রাশিয়ার সুইফট সুবিধা বাতিলকরণ ও বাণিজ্যের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে রাশিয়ার অর্থনীতিতে যে মন্দাবস্থা এবং শেয়ার মার্কেটে যে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয়েছে, তার প্রভাব বিশ্ব-অর্থনীতিতেও পড়তে শুরু করেছে। যার প্রভাব বাংলাদেশের ওপরেও আসছে। বিশেষ করে রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক ও বিনিয়োগের সম্পর্ক রয়েছে; যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে সেখানেও নেতিবাচক প্রভাব পড়া অস্বাভাবিক নয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব বাজারে কতটা পড়বে, তার বিস্তারিত সমকালের মঙ্গলবারের শীর্ষ প্রতিবেদনে এসেছে। অর্থমন্ত্রীর বক্তব্যের সঙ্গে আমিও একমত- তা দেশকে এখনই বড় ঝুঁকিতে ফেলবে না। সংশ্নিষ্ট প্রতিবেদন অনুসারে, পরিস্থিতি মোকাবিলায় ছয়টি সুপারিশ করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। যেমন- ইউক্রেন যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার আগেই বিভিন্ন দেশ থেকে যথেষ্ট পরিমাণে গম ও ভুট্টা আমদানির ব্যবস্থা করতে হবে। পাশাপাশি কৃষ্ণসাগরের আশপাশের দেশগুলোতে যুদ্ধকালীন আকাশপথে পণ্য পরিবহন করা; দেশে বাড়তি গম ও ভুট্টা চাষের ব্যবস্থা করা এবং নতুন নতুন দেশে রপ্তানি বাড়ানোর পরামর্শ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় দিয়েছে। এর মাধ্যমে অর্থনৈতিক প্রভাবও সহজে এড়ানো সম্ভব হবে।
মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রভাবের বিষয়ে আসি। বলার অপেক্ষা রাখে না, এ যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীন ও রাশিয়ার দ্বন্দ্ব আরও প্রকট করে তুলেছে। বস্তুত পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে চীন-রাশিয়ার মেরূকরণ ২০১৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প প্রশাসনের ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই বড় আকারে দেখা গেছে। জো বাইডেন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতায় আসার পরও ন্যাটোর মাধ্যমে তারই পুনরাবৃত্তি করেছেন। বৈশ্বিকভাবে যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার জোট কোয়াড এবং অস্ট্রেলিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের জোট এইউকেইউএসও একই উদ্দেশ্য সাধনে কাজ করছে। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলাকে সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করে পশ্চিমারা পুতিনকে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে খারাপ হিসেবে উপস্থাপন করছে। নতুন মেরূকরণ পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক ধরে রাখতে নতুন চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন শঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না- যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি বাংলাদেশের ওপর চাপ প্রয়োগ করতে পারে, যাতে রাশিয়ার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি করে। অবশ্য পরে যেহেতু ইউক্রেনের পক্ষে বাংলাদেশ ভোট দিয়েছে, তাতে হয়তো পরিস্থিতি ভিন্নও হতে পারে।
তবে মনে রাখতে হবে, রাশিয়ার সহযোগিতায় বাংলাদেশে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি হচ্ছে। চলমান সংকটের কারণে রূপপুরের বিদ্যুৎ প্রকল্পটি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ার শঙ্কার বিষয়টি এরই মধ্যে আলোচনায় এসেছে। আমাদের মনে আছে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরিতে রাশিয়ার সঙ্গে ১২ বিলিয়ন ডলারের চুক্তি সই করে। বিদ্যুতের এ প্রকল্পে রাশিয়ার দিক থেকে অর্থ পেতে সংকট তৈরি হতে পারে।
ইউক্রেন সংকটের ফলে রাশিয়া ও চীন কৌশলগত কারণে পুনরায় গভীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে। পশ্চিমা শক্তি উভয় দেশের অভিন্ন 'শত্রু'। এরই মধ্যে পশ্চিমারা স্পষ্ট করে বলেছে, রাশিয়া ও চীন স্বৈরাচার দ্বারা শাসিত এবং উচ্চাভিলাষের কারণে তারা বিশ্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। আমরা দেখেছি, এরই মধ্যে তারা দেশ দুটির বিরুদ্ধে পদক্ষেপও নিয়েছে। নব্বইয়ের দশকের শেষ দিক থেকে ন্যাটো ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন রাশিয়ার সীমান্তের কাছে তাদের সদস্য যেভাবে বৃদ্ধি করে আসছে, তা রাশিয়ার জন্য ভীতির কারণ। রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের এমন আক্রমণাত্মক নীতির ফলে ভূ-রাজনৈতিক ও কৌশলগত বিষয় এখন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আলোচনার কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। রাশিয়া এবং ইউক্রেনের সঙ্গে পশ্চিমাদের সংযমও নীতি-আলোচনায় মুখ্য বিষয় হয়ে উঠবে।
ভারসাম্যপূর্ণ ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখার বৈদেশিক নীতি চর্চার কারণে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়তে পারে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বাংলাদেশকে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকে এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। এটি বাংলাদেশের জন্য সম্পূর্ণ নতুন পরিস্থিতি। যদিও বাংলাদেশ বৈদেশিক নীতির এ চ্যালেঞ্জ এরই মধ্যে মোকাবিলা করে সফলও হয়েছে। আমরা দেখেছি, দেশের উন্নয়নে বাংলাদেশ এরই মধ্যে বিশ্বের প্রায় সব গুরুত্বপূর্ণ শক্তির সঙ্গে কাজ করতে পারছে। সবার সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে চলার মাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্বকে শক্তিশালী বার্তাও দিয়েছে।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রথমে রশিয়ার বিরুদ্ধে ভোটদানে বিরত থাকা এবং পরে ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেওয়াও সে ভারসাম্যেরই অংশ। আমরা দেখেছি, রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার পরও বাংলাদেশ সরকার রাশিয়া থেকে ৩০ হাজার টন এমওপি সার আমদানির প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। এমনকি এ ক্ষেত্রে সুইফটের মাধ্যমে লেনদেনে কোনো সমস্যা হলে কারেন্সি সোয়াপ বা বিকল্প ব্যবস্থা নেওয়ার বিষয় বিবেচনার কথাও বলেছেন অর্থমন্ত্রী।
বিকশিত অর্থনীতির দেশ হিসেবে এবং বৈদেশিক নীতির দিক থেকেই বাংলাদেশ যে কোনো পরাশক্তির পক্ষে ঝুঁকে পড়া থেকে নিজেকে বিরত রাখছে। ইউক্রেনের পক্ষে ভোট দেওয়ার বিষয়টি অনেকে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডার সেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের প্রভাব হিসেবে দেখতে পারেন। বাস্তবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয় শক্তিকে বাংলাদেশ বার্তা দিচ্ছে যে, জাতিসংঘসহ যে কোনো পর্যায়ে কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বকীয়তা বজায় রেখে গ্রহণ করা হবে। যুদ্ধ বন্ধ করা একটি সর্বজনীন ও মানবিক দাবি। সে বিবেচনায় বাংলাদেশ ২৪ মার্চ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে। এটি বিশেষ কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে নয়। তবে নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া উভয় দেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বজায় রাখার কূটনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে বাংলাদেশ। সবচেয়ে বড় কথা, প্রকৃত বৈদেশিক নীতি অনুসরণের ক্ষেত্রে বিশেষ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করে শান্তি, নিরাপত্তা ও উন্নয়নের বিষয়গুলো মাথায় রেখে এড়িয়ে যাওয়া উচিত। বাংলাদেশ সেই কাজটি করছে; যদিও ইউক্রেন যুদ্ধ ক্রমাগ্রত মেরূকরণের চাপ সৃষ্টি করে যাবে। তারপরও উভয় দিক থেকে যে কোনো আগ্রাসী নীতি কিংবা আচরণের বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়া দেখাতে বাংলাদেশ যথেষ্ট সংযম প্রদর্শন করছে।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
- বিষয় :
- সমকালীন প্রসঙ্গ
- দেলোয়ার হোসেন