শ্রীলঙ্কায় কয়েক মাস ধরে চলছে চরম অর্থনৈতিক সংকট। স্বাভাবিকভাবেই এ সংকটের প্রভাব পড়েছে গোটা জাতির ওপর। তাই সেখানে চলছে চরম বিক্ষোভ। চলমান সংকট কেন তৈরি হলো, তা যেমন খুব স্পষ্ট; তেমনি সমস্যার সমাধানে কী করতে হবে তাও অস্পষ্ট নয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেছে, এসব সংকট মোকাবিলায় পদক্ষেপ নিতে গিয়ে আরও জটিলতর কিছু পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়গুলো আমরা জানি। এ সংকটকে মোটা দাগে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। প্রথমত, সরকারের ব্যয় তার আয়ের চেয়ে অধিক হওয়া। দ্বিতীয়ত, বৈদেশিক মুদ্রার ব্যাপক ঘাটতি এবং তৃতীয়ত, ব্যাপক ঋণ, যা শ্রীলঙ্কার পক্ষে এখন পরিশোধ করা অসম্ভব।

এসব সংকট সামনে রেখে আমরা যখন পার্লামেন্টে উত্তেজনা দেখি, সেখানকার চিৎকার কিংবা বিতর্ক আসলে সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য হচ্ছে না। বরং ক্ষমতাই সেখানে মুখ্য। সরকারের অংশ হিসেবে কারা ক্ষমতায় থাকবে কিংবা কারা ক্ষমতা গ্রহণে ইচ্ছুক, সে আলোচনাই আমরা দেখছি। দুঃখজনক হলেও সত্য, পার্লামেন্টে আলোচনা হচ্ছে পুরোপুরি পদ ও ক্ষমতা নিয়ে। আমরা যারা সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে এ সংকটে ভুগছি, কারা ক্ষমতাসীন, তাতে আমাদের কিছু আসে যায় না। এ অবস্থায় একমাত্র দেখার বিষয় হলো, যারা ক্ষমতায় রয়েছে তারা অর্থনৈতিক সংকটের সমাধান করতে পারছে কিনা। এটা খুবই দুঃখের, একই সঙ্গে গভীর উদ্বেগের বিষয়, যারা পরিবর্তনের জন্য জোর দাবি জানাচ্ছেন তারা কোনো ম্যানিফেস্টো বা ইশতেহার দিচ্ছেন না- প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তারা কী করবেন। কিংবা তারা দেশ শাসনের ক্ষমতা পেলে কী করবেন তাও স্পষ্ট নয়। বিরোধী জোটের বড় কোনো দলই বর্তমান সংকট মোকাবিলা করতে দেশে কীভাবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আনবে তার বিস্তারিত পরিকল্পনা সামনে আনেনি।

যদিও শ্রীলঙ্কায় চলমান বিক্ষোভে পদত্যাগ করেছেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। নতুন প্রধানমন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছেন। এখন যদি প্রেসিডেন্ট পদত্যাগও করেন কিংবা সরকারের পতন ঘটে যায়, তখনও হয়তো পার্লামেন্টে আমরা সেই চিৎকারই দেখব। তখন হয়তো আরেকটি সংকটের উদ্ভব ঘটবে। কোনো রাজনৈতিক দল কিংবা নেতা সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবেন বলে মনে হয় না।

প্রশ্ন হলো, অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় অর্থপূর্ণ পদক্ষেপ কী হতে পারে? বলাবাহুল্য, যখন নতুন সরকার ক্ষমতায় আরোহণ করলেই কি দ্বিমত কিংবা বিতর্কের অবসান ঘটবে? নিশ্চয়ই না। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় তাদের পরিকল্পনার পক্ষে কোনো প্রমাণ দাখিল করেনি। একই সঙ্গে সংকট যে পর্যায়ে গেছে, তা থেকে উত্তরণে যেসব কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন, সেগুলোতে যে সবাই সর্বসম্মতভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন; এমনটি ভাবার কোনো কারণ নেই।

তিনটি মূল সংকটের কথা আগেই বলেছি। সরকারের ব্যয় তার আয়ের চেয়েও অধিক হওয়া কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার ভয়াবহ ঘাটতি এবং ব্যাপক ঋণ, যা শোধ করা প্রায় অসম্ভব। এসব সংকট মোকাবিলায় যথাযথ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের কোনো বিকল্প নেই। সরকারের ব্যয় কমিয়ে একটি পর্যায়ে আনার জন্য অর্থাৎ সরকারের আয় অনুযায়ী ব্যয় ভারসাম্যপূর্ণ করতে গেলে সামরিক স্থাপনা ও সড়ক; এ দুই খাতে ব্যাপক ব্যয় সংকোচন করতে হবে। একইভাবে রাজস্ব ব্যয় বাড়াতে গেলে আয়কর ও ভ্যাট বাড়াতে হবে।

বড় বড় অবকাঠামোগত প্রকল্পের কাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত রাখা প্রয়োজন, যতক্ষণ এ ধরনের প্রকল্পের ব্যয় বহনের মতো আমাদের সক্ষমতা তৈরি না হয়। বস্তুত বৈদেশিক মুদ্রার সংকট এবং ব্যাপক ঋণের কারণে সৃষ্ট আমাদের অর্থনৈতিক সমস্যা মাহিন্দা রাজাপাকসে সরকারের নেওয়া বড় বড় প্রকল্পের কারণেই হয়েছে। বিশেষ করে মহাসড়কের প্রকল্প, হাম্বানটোটা বন্দর তৈরি প্রকল্প, মাত্তালা বিমানবন্দর, সুরাইয়াওয়া ক্রিকেট স্টেডিয়াম, নেলুম কুলুনা, বন্দর সিটি ইত্যাদি প্রকল্পের অর্থনৈতিক কোনো দৃশ্যমান লাভ আমরা দেখিনি। এসব প্রকল্প দেশের খুব কমই উপকারে এসেছে। উল্টো প্রকল্পগুলোর কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ যেমন ব্যাপকভাবে কমেছে, তেমনি ঋণ অনেক বেড়েছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের দুটি প্রধান খাত পণ্যের রপ্তানি ও পরিবহন খাতকে খুব ভালোভাবে কাজে লাগাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। বলাবাহুল্য, দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা এবং দীর্ঘমেয়াদে শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে এ দুটি খাতের যথেষ্ট সক্ষমতা ও সম্ভাবনা রয়েছে। তবে জটিল চ্যালেঞ্জ হলো, এ খাতগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত হবে কীভাবে। তা ছাড়া শ্রীলঙ্কার চলমান বৈদেশিক মুদ্রা সংকটে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়ও বিদ্যমান। এসব শিল্প খাতকে জিইয়ে রাখতে প্রয়োজনীয় ডিজেলের সরবরাহ এবং বিদ্যুৎ নিশ্চিত করতে হবে। রাত ১১টা থেকে ভোর পর্যন্ত বিদ্যুৎ ছাড়া রাখা যেতে পারে। শিল্প খাতের উৎপাদন নিশ্চিত করতে জরুরি বিষয়গুলো যেমন আমদানি করা প্রয়োজন, তেমনি আপাতত অপ্রয়োজনীয় আমদানি সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ রাখা যেতে পারে। এভাবে ভারসাম্য আনা মানে আগামী দিনের সমৃদ্ধি।

এ অবস্থায় শ্রীলঙ্কার মূল চ্যালেঞ্জ কী? মূল চ্যালেঞ্জ হলো এমন একজন নেতা খুঁজে বের করা যাকে কোনো ধরনের দুর্নীতি স্পর্শ করেনি। এমনকি তার কোনো বন্ধু বা আত্মীয়স্বজনও দুর্নীতির দায়ে অভিযুক্ত নয়। রাজাপাকসে পরিবারের দুর্নীতির ব্যাপারে জনমনে যে ধারণা রয়েছে, তা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অন্তত নির্দোষ প্রমাণ হওয়ার আগ পর্যন্ত এটাই সত্য। অভিযোগ রয়েছে, ক্ষমতায় থাকাকালে নিজের পরিবারের প্রায় অর্ধশত সদস্যের শ্রীলঙ্কা সরকারের বিভিন্ন পদে বসান মাহিন্দা রাজাপাকসে। এমনকি তার শাসনামলে লুটপাট ও দুর্নীতিরও ব্যাপক অভিযোগ রয়েছে। দুর্নীতি থেকে শুরু করে শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য এ পরিবারকে দায়ী করছে জনগণ। দুঃখজনক হলেও সত্য, জনগণের এ ধারণা সত্ত্বেও রাজাপাকসে পরিবার তাদের সম্পদের কোনো হিসাব দেয়নি। তাদের ব্যাংকে কত অর্থ আছে কিংবা বিদেশে কেমন সম্পদ আছে, তা প্রকাশ করলেও হয়তো বোঝা যেত তারা কেমন দুর্নীতি করেছে। দুর্নীতি না করে থাকলে এর মাধ্যমে তারা মানুষের ভুল ধারণা ভাঙতে পারত।

রাজাপাকসে পরিবার কিংবা এর বাইরেও কে শ্রীলঙ্কাকে পথ দেখাতে পারেন? ভবিষ্যৎমুখী একটি যথার্থ ভিশন সামনে রেখে কে এগিয়ে যাবেন, যার বাস্তব সুফল আমরা প্রতিনিয়ত দেখব? কোনো অন্তর্বর্তী সরকার এলেও কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে ধীরে ধীরে সংকট কমাতে কে আসবে?

লালিত দি ম্যাল: শ্রীলঙ্কার বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক পরিচালক; শ্রীলঙ্কার ফিন্যান্সিয়াল টাইমস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত; ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক