আবু সালেহ মুহাম্মদ ইউসুফ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের (বিআইআইএসএস) ভারপ্রাপ্ত গবেষণা পরিচালক। তার গবেষণাক্ষেত্রের মধ্যে রয়েছে ভূ-রাজনীতি ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা, বঙ্গোপসাগরের ভূ-রাজনীতি, মিয়ানমারের জাতিগত সংঘাতের ইতিহাস ও গণতন্ত্রায়নের প্রতিবন্ধকতা। তিনি ২০০৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এবং ২০১১ সালে ভারতের পন্ডিচেরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সাউথ এশিয়ান স্টাডিজে স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। তার সর্বশেষ প্রকাশিত নিবন্ধ 'বিটুইন স্ট্রেটোক্রেসি অ্যান্ড মোরাল ডেমোক্র্যাট :অ্যান অ্যাপ্রেইজাল অব মিয়ানমারস পলিটিক্যাল ট্রানজিশন আন্ডার সু চি' ২০২১ সালে বিআইআইএসএস জার্নালে প্রকাশ হয়েছে। আবু সালেহ মুহাম্মদ ইউসুফ ১৯৭৯ সালে লক্ষ্মীপুরে জন্মগ্রহণ করেন।

সমকাল: বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের বিপদে আশ্রয় দিয়েছে; তাদের জন্য ভাসানচরে বিশেষ আবাসন ব্যবস্থা করা হয়েছে। রোহিঙ্গাদের বোঝা বাংলাদেশ কি একাই বহন করছে?

আবু সালেহ মুহাম্মদ ইউসুফ: রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ায় বিশ্বে বাংলাদেশ মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে, যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের মর্যাদা সমুন্নত করেছে। বাংলাদেশ শান্তি ও নিরাপত্তার নীতি অনুসরণ করে- সেটা আরও একবার প্রমাণিত। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর আরও শক্তিশালী ভূমিকা রাখা আধুনিক সভ্যতার দায়। ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা ও স্বার্থের রাজনীতির কারণে বিশ্বের বৃহৎ শক্তিগুলো মানবিক বিষয় হিসেবে রোহিঙ্গা সমস্যাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে সক্ষম হয়নি। তবে বাংলাদেশের কূটনৈতিক দক্ষতা এবং অব্যাহত প্রচেষ্টার কারণে বিশ্বব্যাপী রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে একটি শক্তিশালী জনমত তৈরি হয়েছে, যা বাংলাদেশের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছে।

সমকাল: ২০১৭ সালের শেষদিকে বাংলাদেশ-মিয়ানমারের মধ্যে একটি প্রত্যাবাসন চুক্তি হয়। ওই চুক্তির সর্বশেষ পরিস্থিতি কী?

এএসএম ইউসুফ: রোহিঙ্গা সমস্যাটা মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ এবং এ সমস্যার সমাধান মিয়ানমারকেই করতে হবে। বাংলাদেশ প্রথম থেকেই তার এ অবস্থান পরিস্কার করেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় পর্যায়ে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। তারই অংশ ছিল ওই চুক্তি। দুর্ভাগ্যবশত, চুক্তির বাস্তবায়নে মিয়ানমার সদিচ্ছার পরিচয় দিচ্ছে না। তবে বাংলাদেশের এ তৎপরতার একটি বড় সাফল্য হচ্ছে, বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছে- রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে সসম্মানে এবং স্থায়ীভাবে ফেরত যাওয়াই এ সমস্যার প্রকৃত সমাধান।

সমকাল: মিয়ানমারে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ছাড়া প্রত্যাবাসন সম্ভব?

এএসএম ইউসুফ: ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা কখনও স্থিতিশীল ছিল না। ১৯৬২ সালে সামরিক শাসন আসার পর থেকে মিয়ানমারের আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব প্রবল হতে থাকে। ২০০৮ সালে মিয়ানমারের তৃতীয় সংবিধান প্রণয়নের পরও এই আন্তঃগোষ্ঠী দ্বন্দ্ব সমাধানে কেউ উদ্যোগী হয়নি। ২০১৫ সালে অং সান সু চি ক্ষমতায় এলে তাকে ঘিরে প্রত্যাশা তৈরি হলেও তিনি তা পূরণ করতে পারেননি। বর্তমানে সামরিক সরকার আরও কঠোর নীতি অনুসরণের কারণে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ অস্থিরতা আরও প্রকট আকার ধারণ করেছে। তবে আগের তুলনায় বর্তমানে মিয়ানমার তার প্রতিবেশী রাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বেশি সংযুক্ত। একই সঙ্গে ব্যবসায়িক স্বার্থের কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিমের দেশগুলোর সঙ্গে তার সম্পর্ক রক্ষা করতে হবে। সে ক্ষেত্রে চীন-ভারতসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বৈশ্বিক জনমতের কারণে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধান বিষয়ে মিয়ানমার সরকারকে উদ্যোগী করতে পারে।

সমকাল: রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বহির্বিশ্বের যে ধরনের চাপ মিয়ানমারের ওপর প্রয়োজন, তা কি যথেষ্ট মাত্রায় রয়েছে?

এএসএম ইউসুফ: আমরা যখন আন্তর্জাতিক চাপের কথা বলি, তখন দুই ধরনের চাপকে বোঝানো হয়। একটি হচ্ছে কূটনৈতিক চাপ, অন্যটি অর্থনৈতিক অবরোধ। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে অবরোধ দেওয়ার উদাহরণও দেখা যাচ্ছে। মিয়ানমারের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চাপ দেওয়ার জন্য কোনো কোনো বিশেষজ্ঞের অভিমত- এতে দেশটি চীননির্ভর হয়ে পড়বে। সে ক্ষেত্রে অনেকে দেশটিকে অর্থনৈতিকভাবে সংযুক্ত রাখার পক্ষে। তবে সব বিশেষজ্ঞই এ বিষয়ে একমত, চীনসহ সব আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের বিষয়টি মানবিক দিক বিবেচনায় নিয়ে মিয়ানমারের ওপর আরও চাপ তৈরি করতে পারে। বলে রাখতে হবে, বাংলাদেশ সব সমস্যার কূটনৈতিক সমাধান করতে চায় এবং সেই কূটনৈতিক চাপ কার্যকর পর্যায়ে পৌঁছানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্ব বেশি।

সমকাল: উপযুক্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত আমরা কি অপেক্ষাই করতে থাকব?

এএসএম ইউসুফ: রোহিঙ্গা সমস্যা বাংলাদেশের জন্য একক বোঝা নয়। এর সঙ্গে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তার বিষয়ও জড়িত। রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান না করা গেলে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আন্তঃরাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার বিষয় যেমন- সন্ত্রাসবাদ, মাদক ও মানব পাচার বিস্তারের প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে এগিয়ে আসতেই হবে।

সমকাল: রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন কতটা সম্ভব?

এএসএম ইউসুফ: রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৪তম অধিবেশনে যে কাঠামো প্রস্তাব করেছেন, সব আন্তর্জাতিক পক্ষই নীতিগতভাবে সেটিকে সঠিক সমাধান মনে করে। সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যে অস্থিরতা সেটা সমাধানে মিয়ানমার সরকারের উদ্যোগ নিতে হবে। এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন- মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ যে ধর্মীয় ও জাতিগত সংঘাত রয়েছে, তা মিয়ানমারের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীগুলো কৃত্রিমভাবে তৈরি করেছে। মিয়ানমার সরকার উদ্যোগী হলে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন সম্ভব।

সমকাল: কী কী পদক্ষেপের মাধ্যমে প্রত্যাবাসনের বিষয়টি ইতিবাচক দিকে মোড় নিতে পারে?

এএসএম ইউসুফ: বাংলাদেশ বিষয়টি কূটনৈতিক ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সংযুক্ত করে কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে উদ্যোগী করা যেতে পারে। রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য কফি আনান কমিশনের যে রিপোর্ট, তা অনুসরণ করা যেতে পারে। তবে মিয়ানমার সরকারকে উদ্যোগী করাই প্রধান কূটনৈতিক কাজ। মিয়ানমার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা তৈরি করাই বড় চ্যালেঞ্জ। মিয়ানমার সরকার এ বিষয়ে সদিচ্ছা দেখালে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের যেসব টেকনিক্যাল দিক রয়েছে, সে বিষয়ে জাতিসংঘের সংস্থাগুলো সহায়তা দিতে পারে।

সমকাল: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গা ইস্যুতে সরকারের কূটনৈতিক তৎপরতায় কোনো ধরনের ঘাটতি দেখছেন?

এএসএম ইউসুফ: রোহিঙ্গা সমস্যার শুরু থেকেই বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে তৎপর ছিল। বিষয়টির মানবিক দিক নিয়ে বাংলাদেশ সব সময় আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে সোচ্চার ছিল এবং আছে। এত বিশাল জনগোষ্ঠীকে ঘনবসতিপূর্ণ একটি অঞ্চলে আশ্রয় দিয়ে মানবিক এবং নিরাপত্তার বিষয়গুলো বাংলাদেশ যেভাবে নিশ্চিত করেছে, সেটা বর্তমান বিশ্বে উদ্বাস্তু সমস্যার বিষয়ে একটি রোল মডেলে পরিণত হয়েছে। সে কারণে কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশ যেখানেই রোহিঙ্গা বিষয়টি উপস্থাপন করেছে; কোনো পক্ষই বাংলাদেশের অবস্থানকে অস্বীকার করতে পারেনি। একটি মানবিক রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের যে মর্যাদা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত; সেটা এ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সব পক্ষকে সংযুক্ত করেছে। এমনকি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোহিঙ্গাদের নির্যাতনের ব্যাপারে যারা দায়ী, তাদের শাস্তির বিষয়েও উদ্যোগ তৈরি করেছে।

সমকাল: সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গা নিপীড়নকে 'জেনোসাইড' বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। এর কোনো ইতিবাচক প্রভাব পড়বে?

এএসএম ইউসুফ: রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়ন যে একটি গণহত্যা- তা জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত সব মানবাধিকার সংস্থা আগেই স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে বর্তমান বিশ্বে অন্যতম শক্তিধর দেশ হিসেবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বীকৃতি অবশ্যই গুরুত্ব বহন করে। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং রিপোর্টে রোহিঙ্গা নির্যাতনের বিষয়টি উঠে এসেছে। এ ধরনের একটি গণহত্যার যথাযথ বিচারিক বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সক্রিয় হবে- সেটা সভ্যতার দাবি। এ ক্ষেত্রে বলে রাখা উচিত, বর্তমান প্রেক্ষাপটে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে নিরাপদে ফেরত পাঠানোর বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে আরও কার্যকর ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে আসাই এ সময় বেশি প্রয়োজন।

সমকাল: ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে রোহিঙ্গাদের জন্য আন্তর্জাতিক সহায়তা কমার আশঙ্কা করছে সংসদীয় কমিটি।

এএসএম ইউসুফ: যেহেতু রাশিয়া-ইউক্রেন সমস্যাটি আন্তর্জাতিক ক্ষমতার কাঠামোকে চ্যালেঞ্জ করছে, সে কারণে এ বিষয়টি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশি আলোচিত। অবশ্য সেখানেও বড় ধরনের মানবিক বিপর্যয়ের খবর পাওয়া যাচ্ছে। রোহিঙ্গা সমস্যার সঙ্গে আন্তর্জাতিক ক্ষমতা কাঠামোর সম্পর্ক অতটা গভীর নয়। এটি একটি রাষ্ট্র কর্তৃক নিজ দেশের মানুষের ওপর নির্যাতনের ঘটনা। বিষয়টির মানবিক দিক বিবেচনায় যতটা কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন, তা রাখা গেলে এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সবার দৃষ্টিতে থাকবে।

সমকাল: সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

এএসএম ইউসুফ: আপনাকে এবং সমকালের অগণিত পাঠককেও ধন্যবাদ।