
আবুল মাল আবদুল মুহিত
ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, লেখক, গবেষক, কূটনীতিক ও বাংলাদেশ সরকারের সাবেক সফল অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত এ বছরের ৩০ এপ্রিল পরকালে চলে গেছেন। সদা হাস্যোজ্জ্বল, প্রাণবন্ত, নির্ভীক ও স্পষ্টভাষী এই মহান মানুষটির সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ-পরিচয় হয় ২০০৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাঁর বাসভবন হাফিজ কমপ্লেক্সে। আমরা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তা সেদিন তাঁর কাছে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনে। তিনি ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর অর্থমন্ত্রী হয়ে শাবিপ্রবির অবকাঠামো নির্মাণে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ দেন।
২০১১ সালের ১৩ আগস্ট সৈয়দ মুজতবা আলী হল ও কেন্দ্রীয় অডিটোরিয়াম উদ্বোধন শেষে তিনি প্রধান অতিথির বক্তব্য দেন। আমি তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ। উপাচার্য প্রফেসর ড. মো. সালেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে আমরা কয়েকজন অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়ন নিয়ে অডিটোরিয়ামের ভিআইপি লাউঞ্জে আলোচনায় বসি। আমরা একটি ৮ কোটি টাকার আর অন্যটি ৬৫ কোটি টাকার দুটি উন্নয়ন প্রকল্প তাঁর কাছে তুলে ধরি। তিনি কোনো ভনিতা না করে বললেন, '৮ কোটি টাকার ব্যবস্থা করে দেব। অন্যটি পরে দেখা যাবে।' তাঁর প্রথম মেয়াদে প্রায় ১শ কোটি টাকা ও দ্বিতীয় মেয়াদে ২শ কোটি ৩৮ লাখ টাকার উন্নয়ন প্রকল্প পাস হয়, যা বর্তমানে চলমান। এ ছাড়া আমরা এক হাজার কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প জমা দিয়েছিলাম, যেটা তিনি অনুমোদনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২০১৩ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের গোলচত্বরে মহান মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য নির্মাণকাজ চলছিল। স্বাধীনতাবিরোধী মৌলবাদী গোষ্ঠী ভাস্কর্য নির্মাণে বিরুদ্ধাচরণ করতে থাকে। ভাস্কর্যবিরোধী গোষ্ঠী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাইরে বিভিন্ন কর্মসূচি দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছিল। ভাস্কর্য নির্মাণ নিয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা মহলও বিরোধিতায় ছিল। সে সময়ে অর্থমন্ত্রী অন্য কাজে সিলেটে এসেছিলেন। তিনি এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে আমাকে ফোন করে সিলেটের বাসায় দেখা করতে বললেন। সেদিন আমি ইউজিসিতে একটি সভায় যোগ দিতে ঢাকায় ছিলাম। সেটা জানাতেই জিজ্ঞেস করলেন, তাহলে আপনি কি সচিবালয়ে ২টার পরে দেখা করতে পারবেন? আরও বললেন, 'আমি দুপুরের ফ্লাইটে ঢাকা ফিরব।' আমি তাঁর সঙ্গে সচিবালয়ে দেখা করেছিলাম।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়টি সিলেট মেট্রোপলিটন সিটির আওতাধীন, তবে সিটি করপোরেশন এলাকায় ছিল না। ২০০৯ সালের পে স্কেল অনুসারে মেট্রোপলিটন সিটির আওতাধীন থাকায় অন্য শহরের তুলনায় আমরা ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বেশি পেতাম। কিন্তু ২০১৫ সালের পে স্কেলে বাড়ি ভাড়া বিষয়ে মেট্রোপলিটন সিটির স্থলে সিটি করপোরেশনের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের কথা উল্লেখ করার ফলে এই পে স্কেল অনুসারে আগের তুলনায় ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া কমে যায়। এতে শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা অসন্তোষ প্রকাশ করে আগের মতো ৫ শতাংশ বাড়ি ভাড়া বেশি প্রদানের জোর দাবি জানান। কোষাধ্যক্ষ হিসেবে আমি মতামত দিয়েছিলাম যে বর্তমান পে স্কেল অনুসারে তা দেওয়া বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের পক্ষে সম্ভব নয়। কেননা, এতে অডিট আপত্তি আসবে।
বিশ্ববিদ্যালয়টির অবস্থান সিটি করপোরেশন এলাকার সন্নিকটে ও বর্তমান পে স্কেলে মেট্রোপলিটন সিটির স্থলে সিটি করপোরেশনজুড়ে দেওয়ার ফলে সমস্যাটির উদ্ভব হয়েছে। অর্থমন্ত্রী বিভিন্ন বিষয় ভাবনায় নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ বিভিন্ন এলাকা নিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী অর্থমন্ত্রীর নির্দেশে ২০১৮ সালের নভেম্বরে উপাচার্য প্রফেসর ফরিদ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্বে আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসেন। প্রথমে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী ও পরে তাঁর ভাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রচেষ্টায় সিটি করপোরেশন সম্প্রসারণের গেজেট ২০২১ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশ হয়। তাতে বাড়ি ভাড়া সমস্যারও স্থায়ী সমাধান হয়। তাঁর অবদান বিবেচনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব স্থাপনা গড়ে উঠছে, সেগুলোর যে কোনো একটির নামকরণ তাঁর নামে করার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি।
ইলিয়াস উদ্দীন বিশ্বাস: উপাচার্য, নর্থইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ; প্রাক্তন অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন