
সত্যজিৎ রায় দুর্ভিক্ষ নিয়ে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। তার নাম অশনিসংকেত। চলচ্চিত্রটি ছিল রঙিন। আমার একটু খটকা লাগল, কারণ দুর্ভিক্ষ বলতে আমরা সাদাকালো বুঝি, এই বোঝাটা প্রভাবিত করেছেন শিল্পী জয়নুল আবেদিন। নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক উৎপল দত্তকে প্রশ্ন করেছিলাম ছবিটি সত্যজিৎ রায় রঙিন করলেন কেন? প্রশ্নটি হয়তো তিনিও সত্যজিৎ রায়কে করেছিলেন। উত্তরে বললেন, প্রকৃতি যখন রঙিন তখনই দুর্ভিক্ষটি হয়েছিল। মানে ওই বছর সবচেয়ে বেশি ফসল ফলেছিল। দুর্ভিক্ষটি ছিল মানুষের তৈরি, তাই তিনি দেখিয়েছেন প্রকৃতি যখন ফসলে ভরা, তখনই যুদ্ধের নাম করে এই ধরনের একটি ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ ইংরেজ শাসনামলে ঘটেছিল।
একটু ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ব্রিটিশরা দুর্ভিক্ষের একটা বড় কারিগর। পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের পর লর্ড ক্লাইভ এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির লোকজন এ দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করা শুরু করে। লুণ্ঠনের মাত্রা যে কতটা বেড়ে গিয়েছিল, তার প্রমাণ মেলে ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে। পলাশীর যুদ্ধের সময়েও ঢাকায় এক টাকায় তিন মণ চাল পাওয়া যেত। ২০ বছর পরে চালের দাম দাঁড়াল টাকায় ছয় সের। ঢাকা এবং পূর্ব বাংলা থেকে ব্রিটিশরা চাল-ডালসহ সব খাদ্যদ্রব্য জোরপূর্বক অল্প টাকায় কিনে বাইরে পাঠিয়ে দিত। ওই সময়ে তারা ব্যাপকভাবে নীল চাষ শুরু করে দেয়। মন্বন্তরের নিষ্ঠুরতায় বাংলা, বিহার, উড়িষ্যায় লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। শতাব্দীর শুরুতে যে ঢাকার লোকসংখ্যা ছিল ১০ লাখ, শতাব্দীর শেষে তা এসে দাঁড়ায় ৫০ হাজারে। কোথাও যুদ্ধবিগ্রহ লাগলেই কারণে-অকারণে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যেত। বাংলাদেশে কখনও কখনও বন্যা কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিস্তীর্ণ অঞ্চল প্লাবিত হতো, সেই সুযোগে পণ্যের দাম মজুতদাররা এক দফায় দ্বিগুণ করে দিত। সেই ধারাবাহিকতা আজও চলছে।
এখন চালের দামের সঙ্গে অন্যান্য খাদ্যদ্রব্যের অসংগতি প্রবল। টাকায় ছয় সের তো দূরের কথা, এখন এক মণ ধান বিক্রি করে কৃষককে এক কেজি গরুর মাংস কিনতে হয়। সুদূর রাশিয়ায় যুদ্ধ চলছে, জ্বালানি তেলের দাম এখনও বাড়েনি, কিন্তু রিকশা ভাড়া থেকে শুরু করে বাস ভাড়া প্রবলভাবে বাড়তে শুরু করেছে। দেখা যাচ্ছে, রিকশায় জ্বালানি তেল লাগে না। তবুও ভাড়া দ্বিগুণেরও বেশি বেড়ে গেছে। সবজির সরবরাহে কোনো নাটকীয় ঘটনা ঘটেনি, তবুও দাম দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। চালের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে আর ভেতো বাঙালির খাদ্যসামগ্রীর অন্যান্য অনুষঙ্গ একইভাবে বেড়ে চলেছে। ভোজ্যতেলের বাজারে সহসা অভিযান করলে হাজার হাজার লিটার তেল বেরিয়ে আসছে। এখনও বাংলাদেশ সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা। কিন্তু বাজার বড়ই রুক্ষ্ণ।
বাংলাদেশের মানুষ আবার বড়ই সহনশীল। দোকানদার যা বলছে তার সঙ্গে তর্কাতর্কি না করে অবলীলায় মুখ বুজে পণ্য কিনে নিয়ে চলে যাচ্ছে। দেশের প্রভাবশালী লোকদের কোনো সমস্যা নেই। কারণ তারা বাজারঘাট করেন না। বরং দাম বাড়লে তার সুযোগ-সুবিধার বখরাটা বসে বসে পেয়ে যান। উচ্চবিত্তদেরও সমস্যা নেই। আমলাদের বেতন একলাফে দ্বিগুণ হয়ে গেছে, সেখানে মধ্যবিত্ত আর নেই বললেই চলে। বিপদ হচ্ছে যারা সংখ্যাগরিষ্ঠ তাদের। নিম্ন মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের বেঁচে থাকাই একটা বড় সংকট। কিন্তু চালের ফলন হচ্ছে, শাকসবজির ফলন হচ্ছে, গরু-খাসির মাংসের কোনো ঘাটতি নেই, মসলা সরবরাহের কোনো ঝামেলা নেই, তবুও সব কিছুর দাম বাড়ছে। এমনকি চায়ের দোকানের রুটি, কলা, চা এগুলোরও অনেক দাম বেড়ে গেছে। একদল ব্যবসায়ী মানুষকে জিম্মি করে রাতের অন্ধকারে দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন। আর পরের দিন দরিদ্র-অসহায় সুশীল নাগরিকটি অর্ধেক বাজার করে বাড়ি ফিরছেন।
বাজার যেন একটা নিয়তি। যার বিরুদ্ধে কথা বলে কোনো লাভ নেই। ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সম্পর্কে আজকে নয়, সেই হিউয়েন সাং বা ইবনে বতুতার আমল থেকেই মহাদুর্নাম। তাঁরা দাম বাড়িয়ে শুধু যে নিরীহ মানুষের ঘাড় ভাঙেন তা নয়, তাঁরা ভেজাল মিশিয়ে এক সের দুধকে দেড় সের বানিয়ে মুনাফা করেন। তাঁদের কোনো দল নেই। দলমত নির্বিশেষে এঁরা ঐক্যবদ্ধ। বরং যেসব ব্যবসায়ী একটু সৎ থাকতে চান, তাঁদের ওপর তাঁরা ঝাঁপিয়ে পড়েন। তাঁরা কিছু মোকাম গড়ে তুলেছেন- ঢাকার চকবাজার, চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ, চাঁদপুরের নতুন বাজার এবং প্রত্যেক জেলা-উপজেলা শহরেই এসব মহাজনের দোকান রয়েছে। আসলে এগুলো দোকান নয়, বড় বড় গোডাউন। ব্রিটিশ আপৎকালীন সময়কে বিবেচনা করে রেশন প্রথা চালু করেছিল এবং সিভিল সাপ্লাই নামে একটা বিভাগও খুলেছিল। সেই প্রথাগুলো এখন আর অবশিষ্ট নেই। এখন বাজার অর্থনীতি, মানে ব্যক্তি থেকে রাষ্ট্রের অর্থনীতি সবই বাজার দেখাশোনা করবে। যে বাজারের মালিক কিছু অসাধু-অমানবিক ব্যবসায়ী। তাঁরাই জিকির তুলেছেন বাংলাদেশের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হলো বলে। প্রকারান্তরে তাঁরাই শ্রীলঙ্কা বানাতে চান।
আসলে এসব কাজ তাঁরা করে থাকেন, তাঁদের পেছনে থাকে গডফাদার। গডফাদাররা রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত। ঢাকার একজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বলতেন, আমাদের কোনো দল নেই, দল একটাই সেটা হলো, সরকারি দল। যখন যে দল ক্ষমতায় আসবে, আমরা তাদেরই। দ্রব্যমূল্য স্থিতিশীল রাখা শুধু দায়িত্ব নয়, সেটা সরকারের কৃতিত্বও বটে। সরকার সব সময় ব্যবসায়ীদের সংগঠনের সঙ্গে দেনদরবার করে এবং নানা সুবিধা দিয়ে থাকে। বর্তমানে তো আমাদের সংসদে ব্যবসায়ীদের প্রাধান্য। এই দ্রব্যমূল্যের বিষয়টি নিয়ে যিনি নাড়াচাড়া করেন, তিনিও একজন বড় ব্যবসায়ী। দু'বছর কভিডের সময় জিনিসপত্রের দাম তেমন একটা বাড়েনি, কিন্তু কভিড-১৯ চলে যাওয়ার পর যেখানে পণ্যের দাম কমার কথা, তখনই উল্টো বেড়ে গেল। এ ক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া- এসব বিষয় দেখানো হচ্ছে। অভ্যন্তরীণ বাজারে ডলার বাড়া না বাড়াতে নিজের দেশের উৎপাদিত খাদ্যদ্রব্যের বাজার প্রভাবিত হবে কেন?
সামনে ঈদ। প্রচুর গরুর চাহিদা বাড়বে, সেই সঙ্গে মসলাপাতির অনেক দরকার হবে। এখানে একটা বড় ধরনের খামচা দেবেন অসাধু ব্যবসায়ীরা। ঈদের সময়ে যেহেতু খরচাপাতির ব্যাপারে মানুষ একটু উদার থাকে এবং প্রয়োজনটাও তীব্র, তাই এটাই সঠিক সময়। এসব ব্যবসায়ী বিপুল অর্থে লাভবান হয়ে হজ পালন করতে যাবেন এবং হজ থেকে ফিরে এসে আবার নতুন ফন্দি আঁটবেন। কথা হচ্ছিল দক্ষিণবঙ্গবাসী একজনের সঙ্গে। পদ্মা সেতু হওয়াতে বহুদিন ধরেই তিনি স্বপ্ন দেখছেন, তিনি বাড়ি থেকে এসে প্রতিদিন ঢাকায় অফিস করবেন। কিন্তু বাস ভাড়ার সঙ্গে টোলের টাকা যুক্ত হবে এবং সেই ছুঁতোয় বাস ভাড়া আরেক গুণ বেড়ে যাবে, তখন কী হবে? ভদ্রলোক হিসাব মেলাতে গিয়ে হিমশিম খেলেন। ভদ্রলোক আরও চুপসে গেলেন এই ভেবে, পরিবহনের ওপর সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। যদিও সরকারের এক প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী তাদের নেতা। এই নেতা আসলে কারও কথা মানেন না এবং শুধু পরিবহন মালিকদের স্বার্থ দেখেন। দুর্মুখেরা বলে তাঁর নাকি এ খাত থেকে বিপুল অর্থ উপার্জন হয়।
পরিবহনের একটা নিজস্ব অর্থনীতি আছে। যেখানে ঘুষ, চাঁদাবাজি এবং অন্যান্য খরচ আছে সবটা খরচ মিটিয়ে মুনাফা করতে হয় এবং এই টাকাটা আসে যাত্রীদের কাছ থেকে। যেহেতু এই খরচাপাতি নগদ এবং প্রতিদিনের ব্যাপার, তাই পান থেকে চুন খসার কোনো উপায় নেই। জেলার সবচেয়ে প্রভাবশালী লোকটি এদের নেতা হয়ে থাকেন। ব্রিটিশরা একটি ইংরেজি শব্দ চালু করেছিল, সেই শব্দটির মধ্যে একজন অসহায় মানুষের চেহারা ভেসে উঠে আর সে হচ্ছে পাবলিক। এই পাবলিক অনন্তকাল ধরেই অসহায়। সে রাষ্ট্রীয় অনুশাসন মেনে চলে, আইনকানুন শুধু তার ওপরই প্রয়োগ হয়। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনায় নিরীহ ভোটার হওয়া ছাড়া তার কোনো ভূমিকা নেই। তবে একেবারে নিরীহ পাবলিকরা কখনও তার এলাকা অতিক্রম করে দ্রুত আঙুল ফুলে কলাগাছ হতে পারে, তবে তার একমাত্র গুণ হতে হবে পাবলিক শোষণ এবং নিপীড়ন। পাবলিকরা ঊনসত্তরে খেপেছিল। সত্তরের নির্বাচনে খেপেছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে খেপেছিল। কিন্তু স্বাধীন দেশে সামরিক, বেসামরিক ব্যবস্থায় সে নিদারুণই পাবলিক। পাবলিকের জন্য তাই অশনিসংকেত একটি সার্বক্ষণিক ব্যাপার।
মামুনুর রশীদ: নাট্যব্যক্তিত্ব
মন্তব্য করুন