
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, (১২ ডিসেম্বর ১৯৩৪-১৯ মে ২০২২)
গাফ্ফার চৌধুরী মানে এক ইতিহাস। একজন বরেণ্য সাংবাদিক, একজন সফল কলামিস্ট, একজন কবি। তাঁর প্রয়াণে একটি অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটলো। একুশে ফেব্রুয়ারির সঙ্গে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, বাংলা ভাষা থাকবে- ততদিন গাফ্ফার চৌধুরীর নাম বাঙালির হৃদয়ে অমর, অক্ষয় হয়ে থাকবে। পেশায় সাংবাদিক হলেও ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। পরবর্তীকালে সক্রিয় রাজনীতির সঙ্গে জড়িত না থাকলেও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ধারার রাজনীতির সঙ্গে সব সময় ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রেখেছেন। এ ছাড়া সাহিত্যকর্মী হিসেবে তাঁর ভূমিকা অনস্বীকার্য। কাজ করেছেন সাহিত্যের প্রায় সব শাখায়। তরুণ বয়সে প্রচুর কবিতা লিখেছেন। গল্প, উপন্যাস, স্মৃতিকথা, ছোটদের উপন্যাস ও রাজনৈতিক প্রবন্ধও লিখেছেন।
আমাদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার দিকনির্দেশক, আমাদের অভিভাবক, আমাদের আলোর পথের দিকনির্দেশককে হারিয়ে আমরা হতবিহ্বল। তাঁর কর্মের স্বীকৃতি হিসেবে পেয়েছেন অনেক সম্মাননা ও পুরস্কার। ১৯৬৭ সালে পেয়েছেন বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, একুশে পদক পান ১৯৮৩ সালে এবং স্বাধীনতা পুরস্কার ২০০৯ সালে। ফকির আলমগীরকে গাফ্ফার ভাই ছোট ভাই মনে করতেন। সেই '৮১ সাল থেকে ফকির আলমগীর যতবার লন্ডন গিয়েছিলেন, প্রতিবারই গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে তাঁর বাসায় নয়তো কোনো অনুষ্ঠানে দেখা হতো। ফকির আলমগীরকে দেখলে আবেগতাড়িত হয়ে পড়তেন। যেন একখণ্ড বাংলাদেশকে খুঁজে পেতেন ফকির আলমগীরের মাঝে। বলতেন তুমি আমাকে গেয়ে শোনাও তো ম্যান্ডেলার গানটি- এ গানটি তাঁর খুব পছন্দের ছিল। নয়তো দাম দিয়ে কিনেছি বাংলা- কিংবা ভয় নেই কোনো ভয়, জয় বাংলার জয়। ফকির আলমগীরের দরাজ কণ্ঠের গান শুনলে গাফ্ফার ভাই ফিরে যেতেন সেই অগ্নিঝরা '৭১ কিংবা '৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান কিংবা ভাষা আন্দোলনের অগ্নিস্ম্ফুলিঙ্গের সেই রক্তঝরা দিনগুলোতে। জন হেনরি গানটিও গাফ্ফার ভাইয়ের পছন্দের তালিকায় ছিল। ফকির আলমগীরও গাফ্ফার ভাই বলতে ছিলেন অজ্ঞান। মৃত্যুর মাত্র ১৫ দিন আগে তাঁর ছয়টি বই প্রকাশকের কাছে পাণ্ডুলিপি জমা দিয়ে গিয়েছিলেন, কোনোটির ভূমিকা লিখেছেন, কোনোটির লিখে যেতে পারেননি। কোনটি কাকে উৎসর্গ করবেন, সেটি লিখে অথবা বলে যাননি। আমি অবাক হলাম দেশ-দেশান্তর বইটি তিনি নিজ হাতে উৎসর্গের জন্য লিখে গেছেন। এই বইটি উৎসর্গের জায়গায় লিখেছেন, পরম শ্রদ্ধেয় লেখক, কলামিস্ট ও সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীকে। আজ দু'জনই নেই। মাঝে মাঝে ফোনে কথা হতো গাফ্ফার ভাইয়ের সঙ্গে। প্রবাসে বসবাস করলেও গাফ্ফার ভাইয়ের মন কাঁদত স্বদেশের তরে, স্বদেশের মানুষের জন্য। শিকড়ের সন্ধানে বারবার বাংলাদেশে আসতে চেয়েছেন।
আমার দুইবার তাঁর সান্নিধ্য পাওয়ার সুযোগ হয়েছে। একবার লন্ডনে তাঁর এডওয়ার্ড রোডের বাসায়, আরেকবার বাংলাদেশে। বাংলাদেশে আমাদের বাসায় আসার অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছিলেন। বলেছিলেন, পদ্মার ইলিশ দিয়ে সরষে ইলিশ খাব। কিন্তু আসা হয়নি তাঁর। ২০১৯ সালে আমি একাই গিয়েছিলাম লন্ডনে হিথরো এলাকায়। নর্থহল্টে আমার ছোট বোন ফওজিয়ার বাসা। ফকির আলমগীর আমাকে বারবার বলেছিলেন গাফ্ফার ভাইকে যেন দেখে আসি। গাফ্ফার ভাইয়ের একান্ত ব্যক্তিগত সহকারী রুহুল আমিন ভাই ২০১৯ সালের জানুয়ারির এক বৃষ্টিস্নাত সন্ধ্যায় এলেন ফওজিয়ার বাসায় আমাকে নিতে। আমি রুহুল ভাইয়ের সঙ্গে কিংবদন্তির দেখা পেতে গেলাম এডওয়ার্ড রোডের বাসায়। তিনি ইজিচেয়ারে বসে ছিলেন। আমাকে দেখে খুব খুশি হলেন। তাঁর সঙ্গে অনেক কথা হলো। সেদিনের স্মৃতি ভুলবার নয়।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী শারীরিকভাবে চলে গেলেও তিনি নিশ্চয়ই আসবেন একুশের প্রভাতফেরিতে। তাঁর গান 'আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি আমি কি ভুলিতে পারি' গাওয়ার মাধ্যমে তাঁকে আমরা স্মরণ করবো। একুশ এলেই আবার তিনি আসবেন এই বাংলায় বাঙালির চেতনাকে জাগ্রত করতে। বাঙালির হৃদয়ে চিরকাল থাকবেন তিনি অমলিন, অমর, অক্ষয় হয়ে। গভীর শ্রদ্ধা তাঁকে।
সুরাইয়া আলমগীর: সভাপতি ঋষিজ শিল্পীগোষ্ঠী
মন্তব্য করুন