বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতাকে আর 'বিচ্ছিন্ন ঘটনা' হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। সর্বশেষ গত রোববার ঝিনাইদহের শৈলকুপায় হিন্দুপল্লিতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর এটি ঘটেছে নড়াইলের সাহাপাড়ার হিন্দুদের ওপর হামলা ও তাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগের ঘটনার রেশ শেষ না হতেই। এর কিছুদিন আগে নড়াইলেই ধর্ম অবমাননার অভিযোগ তুলে একজন কলেজ অধ্যক্ষের গলায় জুতার মালা পরানো হয়েছিল পুলিশের উপস্থিতিতে। সাম্প্রতিক সময়ের আরও কিছু অঘটনের মধ্যে রয়েছে- মিথ্যা অভিযোগে বিজ্ঞান শিক্ষক হৃদয় মণ্ডলকে হেনস্তা, রংপুরের ঠাকুরপাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, পাটগ্রামে কোরআন অবমাননার অভিযোগে জুয়েলকে হত্যা, কুমিল্লার মন্দিরে কোরআন রেখে দিয়ে সহিংসতা ও প্রাণহানি। এই তালিকায় আরও জনপদের নাম যোগ করা যাবে- নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নবীনগর, সাঁথিয়া, ভোলার বোরহানউদ্দিন।
একই ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংসতার পুনরাবৃত্তি আশঙ্কাজনক। প্রতিটি ঘটনার পর সরকার কঠোর অবস্থানের কথা ঘোষণা করেছে। তবু কোথাও না কোথাও শৈথিল্যের ফাঁক গলে বারবার একই কায়দায় সাম্প্রদায়িকতার অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। শিক্ষা-বাণিজ্য কমিটির বিশেষ পদ অধিকারের পথে কেউ বাধা হয়ে বসে আছেন; তাঁর গলায় সাম্প্রদায়িক জুতার মালা পরানো হবে। পেছনের যে কোনো ঘটনা মোকাবিলা করার অস্ত্র হিসেবে সাম্প্রদায়িকতাকে ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত বহন করে। বড় ভূমিকম্পের আগে যেমন ছোট ছোট ভূমিকম্প হতে থাকে; এ ঘটনাগুলো হয়তো সে রকম।
ফেসবুকে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ইসলামের অবমাননা কিংবা সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতি আঘাতপ্রাপ্ত হওয়ার অজুহাত তুলে ঘটানো হচ্ছে একের পর এক নির্মম, সহিংস, ধ্বংসাত্মক সাম্প্রদায়িক ঘটনা। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলেও মিথ্যা অভিযোগকারী বা গুজব রটনাকারীকে কিছুতেই চিহ্নিত করা সম্ভব হয় না। ফলে আক্রান্ত মানুষ যারা বেঁচে যায়; ক্ষত-বিক্ষত হয়ে তারা হয় সন্ত্রস্ত-অপমানিত জীবন কাটায়; নয়তো উপায় থাকলে ত্যাগ করে জন্মভূমি। 
সাম্প্রদায়িক ঘৃণা এ অঞ্চলে নতুন নয় এবং তা নয় একপক্ষীয়ও। এ বাস্তবতাকে স্বীকার করে নিয়েই পাকিস্তানের জন্ম হয়েছিল। মুসলমানদের জন্য আলাদা দেশ। ওই একবারই বাঙালি ধর্মভিত্তিক রাজনীতি মেনে নিয়েছিল। তার পরও ১৯৪৭ সালের নতুন পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ শতাংশ মানুষই ছিল হিন্দু। ধর্মভিত্তিক পাকিস্তান থেকে ভয়ে প্রথমে ধনী হিন্দুরা, পরে পাকিস্তান সরকারের হিন্দুবিদ্বেষী নীতির কারণে অন্য হিন্দুরা পাকিস্তান থেকে চলে যেতে শুরু করে হিন্দুস্তান তথা ভারতে।
এদিকে, ১৯৪৮ সালেই বাঙালি মুসলমানের মোহভঙ্গ হয় প্রথমত ভাষা ও সংস্কৃতির প্রশ্নে। এর পর আসে মুসলমান হয়ে মুসলমানদের বিরুদ্ধে শোষণ, বঞ্চনা ও বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার প্রশ্ন। ধর্মীয় রাষ্ট্রের অতি-মুসলমান শাসকদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াইয়ে জয়ী হয়ে ১৯৭১ সালে যখন ভাষা ও সংস্কৃতিভিত্তিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম হয়, তখনও এ দেশে মোট জনসংখ্যার ২১ শতাংশ ছিল হিন্দু।
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রের অন্যতম মূলনীতি হিসেবেই শুধু গ্রহণ করা হয়নি; ধর্মের নামে রাজনৈতিক দল গঠনও নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। সেক্যুলারিজমের বাংলা হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতাকে গ্রহণ করা হয়েছিল বাঙালির নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা এবং সব ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ লালন-পালন করার উদ্দেশ্যে। ১৯৭২ সালের সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদে 'ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা' নিয়ে বলা হয়েছে :ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের জন্য- (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদাদান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তার ওপর নিপীড়ন বিলোপ করা হবে। এ ছাড়া ২৮ ও ২৯ অনুচ্ছেদে 'ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী-পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি' বৈষম্য প্রদর্শন না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর জেনারেল জিয়াউর রহমান সংবিধান থেকে 'ধর্মনিরপেক্ষতা', 'সমাজতন্ত্র' ও 'বাঙালি জাতীয়তাবাদ' মুছে ফেলেন এবং ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর সাংবিধানিক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেন। এর ফলে ফিরে আসে ধর্মীয় রাজনীতি। এর পর জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা দখল করে সংবিধানে যুক্ত করেন রাষ্ট্রধর্ম- ইসলাম।
এখন বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশনে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের ধর্ম ইসলামভিত্তিক নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ১০টি- বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট ও খেলাফত মজলিস। আদালতের নির্দেশে বাতিল হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন। বাংলাদেশ জাতীয় হিন্দু জোট এবং বাংলাদেশ জনতা পার্টির মতো সংখ্যালঘুর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলও আছে। আওয়ামী লীগ ও বিএনপিরও আছে ইসলামভিত্তিক  সহযোগী সংগঠন।
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রের মূলনীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ও বাঙালি জাতীয়তাবাদ ফিরে এলেও বহাল থাকে রাষ্ট্রধর্ম। সংবিধানে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্মের প্রাধান্য ধর্মনিরপেক্ষতাকে জটিল করে তোলে। সাংঘর্ষিক সাংবিধানিক নীতির প্রভাব রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ব্যক্তিগত জীবনে পড়ারই কথা। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় তো এর প্রভাব স্পষ্ট। এ ছাড়া ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনা বিস্তারের অন্যতম প্রধান মাধ্যম ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক চর্চা অব্যাহত রাখার প্রতি প্রাতিষ্ঠানিক নজর কমই চোখে পড়ে। ব্যবস্থা দ্বারা অসাম্প্রদায়িকতার শিক্ষা বিস্তৃত করার উদ্যোগই পারে নতুন প্রজন্মের মধ্যে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে তুলতে। সাম্প্রদায়িক সহিংসতা প্রতিরোধে অসাম্প্রদায়িক চেতনা গড়ে তোলার যথাযথ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিকল্প নেই। 
নূরুননবী শান্ত: গল্পকার, অনুবাদক