
পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আগস্টের প্রথম দিন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতদের যে 'তাণ্ডব' সমকালসহ অন্যান্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে, তাতে বিশ্ববিদ্যালয়টির অসহায়ত্বই আমরা দেখছি। পদবঞ্চিতরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী বটে, কিন্তু তাঁদের ক্ষোভ কোনো শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্নিষ্ট আন্দোলনের জন্য নয়। আবাসিক সুবিধা বৃদ্ধি কিংবা অন্য কোনো যৌক্তিক দাবিতে তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে এমটা করেছেন তা-ও নয়। অথচ তাঁরা কিনা করেছেন; পাঁচটি হলের প্রায় ৪০টি কক্ষে ভাঙচুর চালানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটকে তালা দিয়ে সেখানে আগুন জ্বালানো হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়টিতে সোমবার নিয়মিত শ্রেণি কার্যক্রম ব্যাহত হয়েছে, চার বিভাগের পরীক্ষা বাতিল করা হয়েছে। এমনকি অবরোধের ঘোষণা দিয়ে শাটল ট্রেনের চালকসহ তিনজনকে অপহরণের মতো কাজও করেছেন পদবঞ্চিতরা।
পদবঞ্চিত ৩০ কর্মী, এরপর যুক্ত হন তাঁদের অনুসারীরা। তাতেই ৯টি পরীক্ষা বাতিল করে প্রশাসন। ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা এক দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্ষতি করেছেন, তা পুষিয়ে নিতে সময় লাগবে। সেশনজটের অভিশাপ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ৯টি পরীক্ষা বাতিল করার কারণে পিছিয়ে যাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এই গ্রুপিংয়ের চর্চা এবারের তাণ্ডবলীলায় স্পষ্ট হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, চবি ছাত্রলীগে প্রত্যক্ষভাবে দুটি গ্রুপ রয়েছে। এই দুটি গ্রুপ আবার ৯টি উপগ্রুপে বিভক্ত। এসব গ্রুপ আবার শাটল ট্রেনে বগি নিয়ন্ত্রণ করে। একেক উপগ্রুপের দখলে একেক বগি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ও ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণের কথা শোনা যায়। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেন থাকলে বেচারারা নিয়ন্ত্রক হতে পারতেন!
৩০ জন আন্দোলনকারী একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই দিন জিম্মি করে রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করলেন? সব ব্যাপারেই যদি মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ কী? প্রক্টর-সহকারী প্রক্টর রাখার কী দরকার? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করার অধিকার সব দলের আছে। কেউ পদ না পেলে প্রতিবাদ করতে পারেন। সেই প্রতিবাদ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হতে পারে। কিন্তু আন্দোলনের নামে পরীক্ষা-ক্লাস বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার কাজটি কতটা ন্যক্কারজনক বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁদের দাবি-দাওয়া থাকে এবং সেখানে ছাত্রদের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে- সেই যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাব।
অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা চেয়ে আন্দোলন হয়েছে। সেশন ফি কমানো, হলে সিট বাণিজ্য বন্ধ, খাবারের মান উন্নত করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এসব স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ে আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু চবিতে যা হলো, এর সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া জনস্বার্থের লেশমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। এভাবে ছাত্রলীগ বেসামাল হলে দায় কে নেবে?
দীর্ঘ সময় নিয়ে কমিটি দেওয়ার পরও অছাত্র-বিবাহিতদের কমিটিতে রেখে তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে জয়-লেখকদের। কমিটি ঘোষণার পর ইডেন কলেজে বিক্ষোভ, পাল্টা বিক্ষোভে সেই তোপের প্রতিফলন ফুটে উঠেছিল। এরপর বরিশাল মহানগর কমিটির ক্ষেত্রে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন দেখা গেল। এসব বিক্ষোভ, আন্দোলন অতীতেও হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতরা যে তাণ্ডবলীলা দেখালেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আন্দোলনকারীদের নেতা দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, তাঁরা পদ পাননি। এটি তাঁদের নেতাকে জানাতে অবরোধ দিয়েছেন। তিনি জানার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাই অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কী হাস্যকর যুক্তি! মনে হয়, তাঁরা বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন করেন, তাই সরকারকে জানাতে আন্দোলন। এই প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন বা অ্যাপসভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যমে না জানিয়ে শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করে জানাতে হবে! তাঁরা রাজনীতি করেন, পদ পাবেন কি পাবেন না, সেটা নিয়ে সংগঠনের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন। কিন্তু পদবঞ্চিত হলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারেন; অনশন-মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ কিংবা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের বেদনার কথা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে আনতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে?
মিজান শাজাহান :সাংবাদিক
mizanshajahan@gmail.com
পদবঞ্চিত ৩০ কর্মী, এরপর যুক্ত হন তাঁদের অনুসারীরা। তাতেই ৯টি পরীক্ষা বাতিল করে প্রশাসন। ছাত্রলীগের পদবঞ্চিতরা এক দিনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের যে ক্ষতি করেছেন, তা পুষিয়ে নিতে সময় লাগবে। সেশনজটের অভিশাপ থেকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় বের হয়ে আসতে চেষ্টা করছে। কিন্তু ৯টি পরীক্ষা বাতিল করার কারণে পিছিয়ে যাবে স্বাভাবিক কার্যক্রম।
ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্ত। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও এই গ্রুপিংয়ের চর্চা এবারের তাণ্ডবলীলায় স্পষ্ট হয়েছে। সংবাদমাধ্যমে এসেছে, চবি ছাত্রলীগে প্রত্যক্ষভাবে দুটি গ্রুপ রয়েছে। এই দুটি গ্রুপ আবার ৯টি উপগ্রুপে বিভক্ত। এসব গ্রুপ আবার শাটল ট্রেনে বগি নিয়ন্ত্রণ করে। একেক উপগ্রুপের দখলে একেক বগি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে হল ও ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণের কথা শোনা যায়। ওই সব বিশ্ববিদ্যালয়ে শাটল ট্রেন থাকলে বেচারারা নিয়ন্ত্রক হতে পারতেন!
৩০ জন আন্দোলনকারী একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়কে দুই দিন জিম্মি করে রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, প্রক্টর ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কী করলেন? সব ব্যাপারেই যদি মন্ত্রণালয়কে হস্তক্ষেপ করতে হয়, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাজ কী? প্রক্টর-সহকারী প্রক্টর রাখার কী দরকার? পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি করার অধিকার সব দলের আছে। কেউ পদ না পেলে প্রতিবাদ করতে পারেন। সেই প্রতিবাদ সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য হতে পারে। কিন্তু আন্দোলনের নামে পরীক্ষা-ক্লাস বন্ধ করে দেওয়ার অধিকার কারও নেই। শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ করে দিয়ে, সাধারণ শিক্ষার্থীদের জিম্মি করার কাজটি কতটা ন্যক্কারজনক বলার অপেক্ষা রাখে না। যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কাছে তাঁদের দাবি-দাওয়া থাকে এবং সেখানে ছাত্রদের স্বার্থ জড়িয়ে থাকে- সেই যৌক্তিক দাবিতে আন্দোলনকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাব।
অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের যৌন হয়রানির প্রতিবাদে আন্দোলন হয়েছে। ক্যাম্পাসে নিরাপত্তা চেয়ে আন্দোলন হয়েছে। সেশন ফি কমানো, হলে সিট বাণিজ্য বন্ধ, খাবারের মান উন্নত করার দাবিতে আন্দোলন হয়েছে। এসব স্বার্থসংশ্নিষ্ট বিষয়ে আন্দোলন হতেই পারে। কিন্তু চবিতে যা হলো, এর সঙ্গে ব্যক্তিস্বার্থ ছাড়া জনস্বার্থের লেশমাত্র সম্পৃক্ততা নেই। এভাবে ছাত্রলীগ বেসামাল হলে দায় কে নেবে?
দীর্ঘ সময় নিয়ে কমিটি দেওয়ার পরও অছাত্র-বিবাহিতদের কমিটিতে রেখে তোপের মুখে পড়তে হচ্ছে জয়-লেখকদের। কমিটি ঘোষণার পর ইডেন কলেজে বিক্ষোভ, পাল্টা বিক্ষোভে সেই তোপের প্রতিফলন ফুটে উঠেছিল। এরপর বরিশাল মহানগর কমিটির ক্ষেত্রে একই দৃশ্যের মঞ্চায়ন দেখা গেল। এসব বিক্ষোভ, আন্দোলন অতীতেও হয়েছে। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতরা যে তাণ্ডবলীলা দেখালেন, তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
আন্দোলনকারীদের নেতা দেলোয়ার হোসেন বলেছেন, তাঁরা পদ পাননি। এটি তাঁদের নেতাকে জানাতে অবরোধ দিয়েছেন। তিনি জানার পর ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তাই অবরোধ প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। কী হাস্যকর যুক্তি! মনে হয়, তাঁরা বিরোধী দলের ছাত্র সংগঠন করেন, তাই সরকারকে জানাতে আন্দোলন। এই প্রযুক্তির যুগে মোবাইল ফোন বা অ্যাপসভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যমে না জানিয়ে শাটল ট্রেনের চালককে অপহরণ করে জানাতে হবে! তাঁরা রাজনীতি করেন, পদ পাবেন কি পাবেন না, সেটা নিয়ে সংগঠনের নীতিনির্ধারকদের সঙ্গে বোঝাপড়া করবেন। কিন্তু পদবঞ্চিত হলে শান্তিপূর্ণ আন্দোলন করতে পারেন; অনশন-মানববন্ধন, স্মারকলিপি পেশ কিংবা সংবাদ সম্মেলন করে তাঁদের বেদনার কথা নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিতে আনতে পারেন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পদ নষ্ট করার অধিকার তাঁদের কে দিয়েছে?
মিজান শাজাহান :সাংবাদিক
mizanshajahan@gmail.com
মন্তব্য করুন