বিশ্ববাজারে যখন জ্বালানি তেলের দাম কমতে শুরু করেছে; তখন দেশে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৪২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং অকটেন ৫১ দশমিক ৬৮ ও পেট্রোলের দাম ৫১ দশমিক ১৬ শতাংশ বাড়ানো হলো কোন যুক্তিতে? মাত্র আট মাস আগেই, ২০২১ সালের নভেম্বরে সরকার ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬৫ থেকে ১৫ টাকা বাড়িয়ে ৮০ টাকা করেছিল। সে সময়ই পরিবহন ভাড়া থেকে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যসামগ্রীর মূল্যবৃদ্ধিতে জনজীবনে ভোগান্তি শুরু হয়েছিল। এখন জ্বালানি তেলের প্রায় ৫০ শতাংশ মূল্যবৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে যে ভয়াবহ প্রভাব পড়বে, তা বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কারণ নেই।
দাম বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে জ্বালানি মন্ত্রণালয় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে দাবি করেছে- আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের উচ্চমূল্যের কারণে ফেব্রুয়ারি থেকে জুলাই ২০২২ পর্যন্ত বিপিসি আট হাজার কোটি টাকা লোকসান করেছে। অথচ আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যখন কম ছিল, তখন দেশে এর দাম না কমিয়ে এই বিপিসি বিপুল মুনাফা করেছে। অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকাশিত 'বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২২' অনুসারে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছরের ২৩ মে পর্যন্ত বিপিসি ৪৮ হাজার কোটি টাকার বেশি মুনাফা করেছে। সরকারের দেওয়া ছয় মাসের লোকসানের হিসাবকে সঠিক ধরে নিলেও এই বিপুল মুনাফার টাকা দিয়ে মোট তিন বছরের লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যেত; জ্বালানি মূল্যবৃদ্ধির প্রয়োজন হতো না।
বাস্তবে তিন বছর ধরে এই পরিমাণ লোকসান দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ত না। কারণ তেলের দাম ইতোমধ্যে কমতে শুরু করেছে। যে অপরিশোধিত জ্বালানি তেলের দাম বাড়তে বাড়তে ১৪০ ডলারে উঠে গিয়েছিল, তা বর্তমানে ১০০ ডলারের নিচে নেমে এসেছে। বিশ্বব্যাপী আসন্ন মন্দার কারণে পূর্বাভাস রয়েছে- বছর শেষে তেলের দর ৭০-৮০ ডলারে এবং ২০২৩ সালে তার চেয়ে আরও কম হতে পারে। এ রকম পরিস্থিতিতে ইতোমধ্যে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত মানুষের ঘাড়ে তেলের বিপুল মূল্যবৃদ্ধির বাড়তি বোঝা চাপানো কোনোভাবেই যৌক্তিক নয়।
আরেকটি বিষয় হলো, আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের মূল্য বাড়লে দেশে দাম বাড়ানোর জন্য সরকার যত তৎপর থাকে; আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সংগতি রেখে মূল্য কমানোর ক্ষেত্রে তত তৎপর থাকে না। ২০১৪-১৬ সালে বিপিসি যখন প্রতি লিটার ডিজেল আর কেরোসিনে ২০ টাকা লাভ করছিল, তখন অনেক সমালোচনার পর ২০১৬ সালের এপ্রিলে ডিজেল ও কেরোসিনের দাম ৬৮ থেকে মাত্র ৩ টাকা কমানো হয়েছিল!
সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিপিসির মুনাফার টাকা বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে। তা ছাড়া ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে সরকার বিপিসির তহবিল থেকে উদ্বৃত্ত অর্থ হিসেবে ১০ হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়া-কমা নিয়মিত ঘটনা। ফলে তেলের দাম কম থাকার সময় যে মুনাফা হয়, তা দিয়ে মূল্যবৃদ্ধির সময়কার লোকসান সমন্বয় করতে তহবিল গঠন করা উচিত ছিল। তার বদলে উন্নয়ন প্রকল্পে ব্যয় বা সরকার নিয়ে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। আরেকটা বিষয়, মুনাফা ছাড়াও সরকার বিপিসির কাছ থেকে ট্যাক্স-ভ্যাট বাবদ বছরে ৮-৯ হাজার কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। মুনাফার টাকা ছাড়াও স্রেফ ট্যাক্স-ভ্যাট হিসেবে গত সাত বছরে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকা সরকারকে দিয়েছে বিপিসি। সরকারের উচিত ছিল উন্নয়ন প্রকল্পের প্রয়োজনীয় তহবিল এই করের টাকা থেকে জোগান দেওয়া।
জ্বালানি তেলের দাম না বাড়ানোর আরেকটি বিকল্প উপায় ছিল- জ্বালানি তেলের ওপর কর প্রত্যাহার। জ্বালানি তেল আমদানিতে মোট করভার প্রায় ৩২ শতাংশ। এই কর প্রত্যাহার করে নিলেই বিপিসিকে লোকসান দিতে হতো না; জনগণের ওপর বাড়তি মূল্যের বোঝাও চাপত না।
সরকার অস্বীকার করলেও অনেকের ধারণা- সাম্প্রতিক রিজার্ভ সংকটের প্রেক্ষাপটে আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণের শর্ত হিসেবেই জ্বালানি তেলে ভর্তুকি হ্রাস, অর্থাৎ দাম বাড়ানো হয়েছে। কারণ এর আগে ২০১২ সালে ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতি মেটানোর জন্য আইএমএফের এক্সটেন্ডেড ক্রেডিট ফ্যাসিলিটি (ইসিএফ) ফান্ড থেকে ৯৮৭ মিলিয়ন ডলার ঋণ নেওয়ার শর্ত হিসেবে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানো হয়েছিল। আইএমএফের শর্তের কারণে হোক, আর নিজস্ব সিদ্ধান্তে হোক; তেলের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্তের দায় সরকারকেই নিতে হবে। এক দশকের বেশি সময় ধরে ব্যাপক অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা শুনছি আমরা। এখন এমন পরিস্থিতি কেন হবে যে, মাত্র কয়েক মাসের বৈরী আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির চাপ নিতে পারবে না দেশের অর্থনীতি? তাহলে কেন ঋণ নিতে হবে; তেলের দাম বাড়াতে হবে; লোডশেডিং বা আমদানি নিয়ন্ত্রণ করতে হবে? তাহলে এতদিন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের যেসব কথা বলা হয়েছে, তা কি অন্তঃসারশূন্য?
মনে রাখতে হবে- বাংলাদেশ এখনও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য গার্মেন্টের মতো একক পণ্য রপ্তানি ও রেমিট্যান্স আয়ের ওপর নির্ভরশীল। অর্থনীতির আকারের তুলনায় দেশের অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণের হার অত্যন্ত কম। জ্বালানির মতো কৌশলগত খাতে জাতীয় সক্ষমতা গড়ে ওঠেনি। বরং আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে; চাহিদার তুলনায় বাড়তি বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার জন্য ক্যাপাসিটি চার্জের বোঝা বেড়েছে; দেশের ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের সমস্যা বেড়েছে; অনিয়ম-দুর্নীতি-মুদ্রা পাচার বেড়েছে। সব মিলিয়ে স্রেফ কয়েক মাসের জ্বালানির উচ্চমূল্য সামাল দেওয়ার জন্য অস্বাভাবিক হারে দাম বাড়িয়েছে সরকার। যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের সাধারণ মানুষকে।
ডিজেল ও কেরোসিন প্রাথমিক জ্বালানি পণ্য, যা কৃষি, পরিবহন ও বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতে ব্যবহূত হয়। ফলে এর মূল্যবৃদ্ধিতে খাদ্যদ্রব্য ও পরিবহন খরচ থেকে প্রায় সব ধরনের পণ্য ও সেবার মূল্য বেড়ে যায়। এ জন্য আন্তর্জাতিক বাজারে মূল্য বাড়লেই ডিজেল-কেরোসিনের দাম বাড়িয়ে দেওয়া উচিত নয়। বরং দেশের সার্বিক অর্থনীতি ও জীবনযাত্রার কথা চিন্তা করে কর ও ভ্যাট হ্রাস করে, এমনকি প্রয়োজনে ভর্তুকি দিয়ে হলে এগুলোর দাম কমিয়ে রাখতে হয়। বর্তমান পরিস্থিতিতে এমনকি নতুন করে ভর্তুকি দেওয়ারও প্রয়োজন পড়ে না। স্রেফ বিপিসির আগের মুনাফা থেকে সমন্বয় করলে এবং সরকারি কর ও ভ্যাট আহরণে ছাড় দিলেই জনগণ ও অর্থনীতির ওপর জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধির বাড়তি চাপ এড়ানো যায়।
কল্লোল মোস্তফা: লেখক, প্রকৌশলী, নির্বাহী সম্পাদক, সর্বজনকথা