চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ইর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফর নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না, বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে শক্তিশালী দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক গত এক দশকে বহুমাত্রিকে রূপ নিয়েছে। বিশেষ করে এক যুগে যেভাবে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধিত হয়েছে এবং শক্তিশালী রাষ্ট্র ও বিভিন্ন অংশীদারের সঙ্গে বাংলাদেশ ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আসছে; চীন তার বাইরে নয়। এমন এক সময়ে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর অনুষ্ঠিত হয়, যখন একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক সংগঠন বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিশেল জে সিসন ঢাকা সফর করেন। বিষয়টি কাকতালীয় হলেও মনে রাখতে হবে। আমরা যেমন ইউক্রেন যুদ্ধ দেখছি, তেমনি তাইওয়ান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের নতুন উত্তেজনাও স্পষ্ট। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র কিংবা চীন উভয়ের দিক থেকেই বাংলাদেশের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ।
আমাদের মনে আছে, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের সফরে ২০ বিলিয়ন ডলারের ২৭টি প্রকল্পের চুক্তি হয়েছিল। সে চুক্তিগুলো জিটুজি বা দুই দেশের সরকারের মধ্যে হয়েছে। সেগুলোর সঙ্গে এখন পিপিপি বা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে নতুন চুক্তি হচ্ছে। পিপিপি বা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব মডেলে দেশগুলোর সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্কের বিষয়কে বাংলাদেশ স্বাগত জানিয়েছে। পিপিপি মডেলে চীনের প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে কাজ করবে। তারাই বাংলাদেশে প্রকল্পে বিনিয়োগ করবে এবং আলোচনার মাধ্যমে ১০-২০ বছরের ব্যবধানে তাদের অর্থ সেই প্রকল্প থেকে তুলে নিয়ে যাবে। এতে ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকি কমে আসবে।
চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে চারটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। বাংলাদেশ-চীন মৈত্রী সেতুর হস্তান্তর সনদ, দুর্যোগ মোকাবিলা সহায়তার জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি সমঝোতা নবায়ন, ২০২২-২৭ মেয়াদে সাংস্কৃৃতিক সহযোগিতা সমঝোতা নবায়ন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চীনের ফার্স্ট ইনস্টিটিউট অব ওশেনোগ্রাফির মধ্যে মেরিন সায়েন্স নিয়ে সমঝোতা স্মারক। যদিও চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরকে রুটিন কাজ বলা চলে। মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের কয়েকটি মেগা প্রকল্পে চীনের অর্থায়ন রয়েছে। প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার বিষয়ও রয়েছে।
'এক চীন' নীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান বরাবরই স্পষ্ট। যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদের স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির সাম্প্র্রতিক তাইওয়ান সফর ঘিরে উত্তেজনার কারণে 'এক চীন' নীতি আবার আলোচনায় আসে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই এবং বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মধ্যে বৈঠকেও 'এক চীন' নীতির ব্যাপারে বাংলাদেশের অবস্থানের বিষয়টি স্পষ্ট করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গেও ওয়াং ইর বৈঠকে এ নিশ্চয়তা দেওয়া হয়- চীনের সঙ্গে বন্ধুত্বকে বাংলাদেশ মূল্য দেয় এবং 'এক চীন' নীতিতে বিশ্বাস করে। ইউক্রেন সংকটের প্রভাবে বিশ্বে আরও নানা সংকট তৈরি হয়েছে। বিশ্বে মূল্যস্ম্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিদ্যুতের সংকট বেড়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সাপ্লাই চেইন ভেঙে পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী এ সংকট মোকাবিলায় তাই চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে এশিয়ার দেশগুলোকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কথা বলেছেন। আমি মনে করি, প্রধানমন্ত্রীর এ আহ্বান অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ।


চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সফরে আমাদের দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ রোহিঙ্গা সংকটের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে ওয়াং ইর সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী উভয়ে চীনের ভূমিকার কথা উল্লেখ করেন। এর আগে বাংলাদেশের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চীনের প্রেসিডেন্টও রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে সহযোগিতার আশ্বাস দেন। চীনের মাধ্যমে ত্রিপক্ষীয় একটি প্রক্রিয়া শুরুও হয়েছিল। চীন, মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে এ নিয়ে একাধিক বৈঠক হয়েছিল। মিয়ানমারে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেওয়ার পর সে প্রচেষ্টা আটকে যায়। বাংলাদেশ স্বাভাবিকভাবে চীনকে অনুরোধ করেছে, ওই প্রক্রিয়া যাতে পুনরায় চালু হয়। চীন এ নিয়ে মিয়ানমারকে জানিয়েছে। তবে মিয়ানমার জানিয়েছে, তারা প্রথমে স্থিতিশীল হতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন। এ বিষয়ে চীন বাংলাদেশকে সহযোগিতা করবে বলে জানিয়েছে। প্রেস সচিবের বক্তব্য অনুযায়ী, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশের জন্য বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাড়তি বোঝা হয়ে উঠেছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রদর্শন করেছেন। তাঁর মতে, চীন আশা করে, বাংলাদেশ আর মিয়ানমারের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে। যদি তৃতীয় কোনো পক্ষের অংশ নেওয়ার দরকার হয়, চীন তার ভূমিকা পালন করতে প্রস্তুত। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের জন্য ঘরবাড়ি বানানো হচ্ছে বলেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন ওয়াং ই।
চীন সেপ্টেম্বর থেকে ৯৮ শতাংশ বাংলাদেশি পণ্যে শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকারের কথা বলেছে। এটি নিঃসন্দেহে ইতিবাচক। তা ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে দুই দেশের মধ্যকার বিশাল বাণিজ্য ঘাটতি কমানোর ব্যাপারেও বলা হয়েছে এবং তাতে চীনের পক্ষ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া গেছে। চীন থেকে আমরা যত পণ্য কিনি; আমাদের রপ্তানি সে তুলনায় অত্যন্ত কম। চীন থেকে বাংলাদেশ প্রতিবছর ১৩০০ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করে। অন্যদিকে বাংলাদেশ থেকে চীনে রপ্তানি হয় মাত্র ৬০ কোটি ডলার। এই বিরাট ব্যবধান কমাতে হলে চীনের আন্তরিকতা জরুরি। চীন ৯৮ শতাংশ পণ্যে শুল্ক্ক ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দিয়েছে বটে; তাতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বাদ পড়েছে। যেমন গার্মেন্ট, সবজি, ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো পণ্য রপ্তানিতে চীন এ সুবিধা দিলে বাণিজ্যিক ঘাটতি কমবে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এ সফরে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের দক্ষ জনশক্তি ব্যবহার, বাংলাদেশে বিনিয়োগ আরও বাড়ানো, বাংলাদেশি ছাত্রছাত্রীদের দ্রুত শিক্ষার্থী ভিসা দেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানানো হয়েছে। আশা করা যায়, এসব ব্যাপারেও শিগগির দেশটি যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আগেই বলেছি, বাংলাদেশ কূটনীতিতে ভারসাম্য বজায় রেখে আসছে। আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূলমন্ত্র 'সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারও সঙ্গে শত্রুতা নয়'- বাস্তবে সেটাই আমরা দেখছি। এটা জরুরি এ কারণে, এখন বিশ্বে মেরূকরণ হচ্ছে। বিশ্বের শক্তিশালী পক্ষগুলোর মধ্যে সম্পর্কের অবনতি যত বেশি হচ্ছে, সমস্যা তত বাড়ছে। জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস সম্প্রতি যথার্থই বলেছেন, বিশ্বব্যাপী চলমান সংকটের কারণে পারমাণবিক বিপর্যয়ের যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে তাতে মনে হচ্ছে, বিশ্বমানবতা একটি 'গুলি ভরা বন্দুক' নিয়ে খেলছে। এ অবস্থা থেকে সবাইকে একসঙ্গে উঠে আসতে হবে।
পরাশক্তিগুলোর বৈরিতার মধ্যে বাংলাদেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে কারও মধ্যে যেন ভুল বোঝাবুঝি না হয়, সেখানেও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা প্রয়োজন। ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক ও কৌশলগত দিক বিবেচনা করেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত