
বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট নিয়ে নানামুখী বিশ্নেষণ আছে। কিন্তু দ্বিমতের অবকাশ নেই যে, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সংকট বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আরোপিত; যার শুরু রাষ্ট্রের স্থপতিকে হত্যার মধ্য দিয়ে; লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধকে আঘাত করার মধ্য দিয়ে।
একাত্তরের ইতিহাসের প্রতি বৈরিতা ও পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের ঘটনা দুটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বাভাবিক অগ্রযাত্রার মৌলিক প্রতিবন্ধক। এটিও মনে করার কারণ আছে- একাত্তরের পরাজিতরাই খোলস বদলে পঁচাত্তরের কুশীলব হয়েছিল। তারা ভেবেছিল, রাষ্ট্রপিতার হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে সদ্য স্বাধীন দেশের সব অর্জন ধূলিসাৎ করা সম্ভব হবে। শেষ পর্যন্ত সে আশা পূরণ হয়নি। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ইতিহাস ও বাঙালির অন্তর্নিহিত শক্তি যূথবদ্ধভাবে প্রত্যাঘাত করেছে। সাময়িকভাবে হলেও একাত্তর ও পঁচাত্তরের কুশীলবরা পর্যুদস্ত হয়েছে; বাংলাদেশ আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন করেছে। নানা সংকট ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও এগিয়ে যাচ্ছে জাতি। বাংলাদেশের নতুন নাগরিকরা আজ সমাজ নিয়ন্ত্রণ করছেন; জ্ঞানবিজ্ঞান, প্রযুক্তি, ব্যবসা ও খেলাধুলায় অবাক করা সাফল্য বয়ে আনছেন। কিন্তু এই নতুন নাগরিকদের একটি তাৎপর্যময় অংশের মন থেকে মৌলিক কিছু প্রশ্ন আজও দূর করা সম্ভব হয়নি বলে আমার ধারণা। কারণ, এরা আজও ধর্মীয় উগ্রবাদ ও ধর্মান্ধতার হাতে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি গ্রাস করার চেষ্টা দেখছে।
১৯৭৫ থেকে ১৯৯০- এ সময়ে রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হয়েছে অবৈধ সেনাপতি শাসক কিংবা তাদের গড়া নব্য রাজনীতিবিদের হাতে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে যে সাম্প্রদায়িকতাকে বিতাড়ন করা হয়েছিল; তাকে এ সময় নতুন করে জাগিয়ে তোলা করা হয়েছে। ১৯৭৫-পরবর্তী শাসকদের হাতে রাষ্ট্রের স্থপতি চরমভাবে উপেক্ষিত ও অপমানিত হয়েছেন। উপেক্ষিত হয়েছে মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, চেতনা ও আদর্শ। ফলে গজিয়েছে নানা পরগাছা। এরই ফলে স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি খুঁটি গেড়ে বসেছে; তারা ধনেজনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এর সবই করা হয়েছে পরিকল্পিতভাবে, যাতে ব্যর্থ হয় এই জনপদের জনগণতান্ত্রিক উদার সংস্কৃতি ও লাখো মানুষের আত্মদানের মুক্তিযুদ্ধ।
১৯৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী সফল আন্দোলনের পর থেকে রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক নবযাত্রা শুরু হয়। কিন্তু সে যাত্রাও মসৃণ হয়নি। বারবার বাধাগ্রস্ত হয়েছে গণতান্ত্রিক বিকাশ। এর প্রধান কারণ এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নে; মুক্তিযুদ্ধের চেতনা লালন ও ইতিহাস সংরক্ষণ প্রশ্নে; বাঙালির অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার প্রশ্নে প্রতিপক্ষ হিসেবে অবস্থান নিয়েছে সেনাপতি-রাজনীতিবিদ ও তাদের সৃষ্ট দলগুলো। এরা ক্রমাগতভাবে অস্বীকার করে গেছে বঙ্গবন্ধুকে; এমনকি মুক্তিযুদ্ধকে। আঘাত হেনেছে বাঙালির সেক্যুলার সমাজশক্তিকে।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়- বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এই বৈরিতায় জাতি বিভক্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং লাভবান হয়নি তারাও, যারা ইতিহাস হত্যার ভয়ংকর ষড়যন্ত্রে মেতে উঠেছিল। অনস্বীকার্য, এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রের যাত্রাপথ কণ্টকাকীর্ণ ও জনগোষ্ঠী উত্তরোত্তর বিভাজিত হয়েছে। এরে ফলে সংকট গ্রাস করেছে সমাজকে।
কিন্তু ইতিহাসের নিজের যে শক্তি আছে, তাকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি। শত প্রতিবন্ধকতার পরও ইতিহাসের অমোঘ নিয়মে বাংলাদেশের জাতির পিতার হত্যাকাণ্ডের বিচার হয়েছে, যদিও তা ঠেকানোর সব চেষ্টা করা হয়েছিল। এমনকি বিচার ঠেকানো যায়নি একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী তস্করদেরও।
অতএব দেরিতে হলেও ইতিহাসের অমোঘ সত্যশক্তি মূর্খতার দুয়ারে আঘাত করে জাগিয়ে দিতে চেয়েছে। ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীগুলোর নিরন্তর বিষবাষ্প ছড়ানোর পরও নতুন প্রজন্মের বৃহৎ অংশ আজ মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসের প্রতি আস্থাশীল। নতুন নাগরিকদের মনোজাগতিক এই উত্থান ইতিহাসের আরেক আশীর্বাদ। এর পরও সত্য এই- আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই।
বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে সে কারণেই নতুন উপলব্ধি আসা বাঞ্ছনীয়। পুরোনো ব্যর্থতা ও কলংক থেকে বেরিয়ে ন্যায় ও সত্যকে গ্রহণ করা জরুরি। আমার বিশ্বাস, উপলব্ধির এই ধারাটি সূচনা করে রাজনীতিতে সমূহ সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করা সম্ভব। এ উপলব্ধির মূল শর্ত- অতীতের ব্যর্থতা থেকে বেরিয়ে নিঃশর্তভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর ঐতিহাসিক মহিমায় গ্রহণ; তাঁর হত্যাকারীদের বিচারকে সমর্থন; মহান মুক্তিযুদ্ধের অবিকৃত ইতিহাসকে পরিপূর্ণ মর্যাদায় অধিষ্ঠান এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধী তস্করদের ঐতিহাসিক বিচার প্রক্রিয়ার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন দান করা, যা জাতীয় ঐকমত্যের মৌল শর্ত।
গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা অপরাধ কিছু নয়। অপরাধ হচ্ছে, সরকারের বিরোধিতার নামে সাম্প্রদায়িক সমাজশক্তিকে প্রশ্রয়; জাতির পিতাকে অবজ্ঞা; জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে উপেক্ষা; বিতর্কিত এবং রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ বিরোধিতাকারীদের সঙ্গে আঁতাত করে অসাম্প্রদায়িক জাতীয় চেতনা ও ইতিহাসের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করা।
আমি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি, জাতীয় সমঝোতার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে- নিঃশর্ত এবং পরিপূর্ণ সততা ও আবেগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রহণ; একই সঙ্গে জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করা। যতদিন না এ কাজটি করা সম্ভব হবে, ততদিন সংকট জিইয়ে থাকবে; জাতীয় ঐক্য বিনষ্ট হবে।
আগস্টের ১৫ তারিখ জাতির পিতার হত্যাবার্ষিকী পালিত হয় প্রতি বছর; পালিত হয় জাতীয় শোক দিবস। শুধু আওয়ামী লীগ নয়; নানা মত-পথ থেকে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়, যা ইতিহাসের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতার বহিঃপ্রকাশ। লক্ষ্য করার বিষয়, বেশ কিছু দল ও গোষ্ঠী আজও জাতীয় ঐক্যের সঠিক উপলব্ধিতে আসতে পারেনি। পারলে ঐক্যের পথে বড় বাধাটি দূর করা সম্ভব হতো। সবাইকে পূর্ণ উপলব্ধিতে বুঝতে হবে- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ কোনো দলের নন। ইতিহাসের পরিক্রমায় তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপিতা, জাতির পিতা; বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্থপতি এবং যা ইতিহাসের অলঙ্ঘনীয় সত্য।
বঙ্গবন্ধুর যাঁরা দলগত অনুসারী, তাঁদেরও উচিত হবে জাতির পিতাকে গণ্ডিবদ্ধ না করে, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ এই শুদ্ধতম ও শ্রেষ্ঠতম নেতাকে সর্বজনীন করা। তাঁর আদর্শকে সত্যিকার মর্মে উপলব্ধি ও বেগবান করা। কাজেই মূলে ফিরে যেতে হবে। নির্মোহভাবে সংকটের সমাধান খুঁজতে হবে। এর ব্যতিক্রম ঘটলে আমরা শুধু উত্তরোত্তর সংকটেই জর্জরিত হবো।
ক্রমাগত আঘাতে দীর্ঘকাল পর্যুদস্ত থাকলেও আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুক্তিযুদ্ধ ও গণতান্ত্রিক শক্তি আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। তারা তাদের ব্যর্থতা, বিভেদ ও আত্মতুষ্টির প্রতিক্রিয়া অনুভব করেছে। দিন যত যাবে, ততই মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধু- আমার দৃঢ় বিশ্বাস, অপ্রতিরুদ্ধ হবেন; আজ যা তার চেয়েও অনেক বেশি।
কোনো সরকার, ক্ষমতাশীন দল বা জোটের কার্যক্রমের সমালোচনা বা সীমাবদ্ধতার ঊর্ধ্বে নয়। সে কারণে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বিকাশে সরকারবিরোধীদের স্বাধীন কার্যক্রম জরুরি। এ ছাড়া আধুনিক রাষ্ট্র হয় না। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে, ধর্মীয় উগ্রবাদীদের সমন্বয়ে যে রাজনৈতিক মোর্চা, তারা রাষ্ট্রের মৌলিক ইতিহাস ও চেতনার প্রতিপক্ষ; প্রতিপক্ষ অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদের।
সে কারণেই বলি, রাজনৈতিক যুদ্ধের পাশাপাশি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক যুদ্ধকে এগিয়ে নিতে হবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের চর্চাকে ছড়িয়ে দিতে হবে। দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে জেতার জন্য প্রয়োজন আদর্শিক যোদ্ধা তৈরি করা। ভুলে গেলে চলবে না- অসাম্প্রদায়িক জাতিসত্তার শত্রুরা প্রাথমিকভাবে পরাজিত হলেও তারা দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে নেমেছে। কাজেই আত্মতুষ্টির সুযোগ নেই। আমার বড় দুঃখ হয় যখন দেখি আদর্শিক রাজনীতির ক্রমান্বয়ে পতন ঘটছে; রাজনীতি শুধুই স্লোগানসর্বস্ব হয়ে উঠছে, যা হয়তো সাময়িক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে সক্ষম, কিন্তু বৃহৎ আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য নয়।
হারুন হাবীব: মুক্তিযোদ্ধা ও লেখক
মন্তব্য করুন