
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ৪৮ বছর পূর্ণ হয়েছে এ বছর। এ উপলক্ষে মনে পড়ছে ১৯৭৪-এর ২৫ সেপ্টেম্ব্বরের কথা। যেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতিসংঘে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা করে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক অনন্য ও মহত্তর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। জাতির জনকের সফরসঙ্গী হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে যোগদানের সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বছর ঘুরে দিনটি এলে অনুপম সেই স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা মানসপটে ভেসে ওঠে। আমাদের জাতীয় জীবনে এই দিনটির গুরুত্ব অপরিসীম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা জাতির জনকের দৃষ্টান্ত অনুসরণে ইতোমধ্যে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন।
আজ থেকে ৪৮ বছর আগে ১৯৭৪-এর ১৮ সেপ্টেম্বর বুধবার, ঐতিহাসিক এই দিনটির সূচনা হয়েছিল। বাংলাদেশ সময় ভোর ৪টায় জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য রাষ্ট্ররূপে আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করা হয়। এই ঘোষণা শোনার অধীর আগ্রহে অপেক্ষমাণ বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, 'আমি সুখী হয়েছি যে, বাংলাদেশ জাতিসংঘে তার ন্যায্য আসন লাভ করেছে। জাতি আজ গভীর কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করবে যাঁরা বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে তাঁদের জীবন উৎসর্গ করে গেছেন। সেই শহীদদের কথা জাতি আজ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছে।'
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে সদ্য সদস্যপদপ্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা। বক্তৃতা দেওয়ার জন্য বঙ্গবন্ধুর নাম যখন ঘোষিত হয়, তখন বিশ্বনেতাদের মুহুর্মুহু করতালিতে চারদিক মুখর। মঞ্চে দাঁড়িয়ে স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে চারদিকে তাকিয়ে পরিষদে সমাগত বিশ্বনেতাদের সম্বোধন করে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সর্বোচ্চ সংস্থা জাতিসংঘকে 'মানবজাতির মহান পার্লামেন্ট' উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতা শুরু করেন। জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুই প্রথম রাষ্ট্রনায়ক, যিনি মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা দেন। বঙ্গবন্ধু বক্তৃতায় বলেছিলেন, 'শান্তি ও ন্যায়ের জন্য পৃথিবীর সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা বিমূর্ত হয়ে উঠবে- এমন এক নয়া বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তুলতে বাংলাদেশ আজ পূর্ণ অঙ্গীকারবদ্ধ।' তিনি আরও বলেন, 'জাতিসংঘের সনদে যেসব মহান আদর্শ উৎকীর্ণ রয়েছে, তারই জন্য আমাদের দেশের লাখ লাখ মানুষ চরম ত্যাগ স্বীকার করেছে।'
পিনপতন নিস্তব্ধতার মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৪৫ মিনিটের বক্তৃতা শেষে সভাপতি নিজেই যখন দাঁড়িয়ে করতালি দিচ্ছেন, তখন স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়ক ও প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিপুলভাবে করতালি দিয়ে আলিঙ্গন করে অভিনন্দিত করেছেন বঙ্গবন্ধুকে। অভাবনীয় সেই দৃশ্য।
মাতৃভাষা বাংলায় বক্তৃতা দেওয়ার বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্তটি ছিল তাঁর সারাজীবনের স্বাভাবিক ও যৌক্তিক পরিণতি। সেদিন বক্তৃতারত বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকিয়ে কেবলই মনে হয়েছে, তিনি যেন বহুযুগ ধরে এমন একটি দিনের অপেক্ষায় নিজেকে প্রস্তুত করেছিলেন। মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ।
মাতৃভাষায় বঙ্গবন্ধু মুজিবের এই ঐতিহাসিক বক্তৃতার পর অধিবেশনে আসা পাঁচটি মহাদেশের প্রতিনিধিরা এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বহুল পঠিত জাতিসংঘের 'ডেলিগেট বুলেটিন' বঙ্গবন্ধুকে 'কিংবদন্তির নায়ক মুজিব' বলে আখ্যায়িত করে। বুলেটিনটিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কদের প্রদত্ত মন্তব্য-প্রতিক্রিয়া পত্রস্থ করা হয়। বুলেটিনের সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছিল, 'এযাবৎ আমরা কিংবদন্তির নায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের নাম শুনেছি। এখন আমরা তাঁকে কাজের মধ্যে দেখতে পাব।' জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সম্পর্কে বলা হয়, 'বক্তৃতায় ধ্বনিত হয়েছে মুজিবের মহৎ কণ্ঠ।'
এরপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, বিশ্বব্যাপী মুদ্রাস্ম্ফীতিজনিত সমস্যা এবং বাংলাদেশে সর্বনাশা বন্যার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতি পর্যালোচনায় জাতিসংঘ মহাসচিবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনায় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল অংশগ্রহণের। কাছ থেকে দেখেছি, অসাধারণ রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞায় জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছে স্বদেশের প্রায় দুর্ভিক্ষাবস্থার গুরুত্ব তুলে ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলোচনার পর জাতিসংঘ বাংলাদেশের ত্রাণকার্যে ৭০ লাখ ডলার সহায়তা দিয়েছিল এবং উপমহাসচিব ড. ভিক্টর উমব্রাইখটকে বাংলাদেশের সমস্যার প্রতি বিশেষ নজর রাখার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর সম্মানে নিউইয়র্ক সিটি হলে আয়োজিত এক সংবর্ধনা সভায় নিউইয়র্কের মেয়র বঙ্গবন্ধুকে নগরীর চাবি উপহার দেন এবং বলেন, 'এই উপহার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও জনগণের প্রতি আমেরিকার জনগণের শ্রদ্ধা ও বন্ধুত্বের নিদর্শন।' প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, 'বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যাঁরা আত্মদান করেছেন, সেইসব শহীদের আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পক্ষ থেকে এই চাবি গ্রহণ করে তিনি সম্মানিত বোধ করছেন।' বক্তৃতায় তিনি আরও বলেছিলেন, 'আমাদের স্বাধীনতা-সংগ্রামে আমেরিকার জনগণ যেভাবে সমর্থন জুগিয়েছিল, আমি চিরকাল তা কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করব।' নিউইয়র্ক নগরীর মেয়রের উদ্দেশে বলেছিলেন, 'নিউইয়র্ক নগরীতে জাতিসংঘের সদরদপ্তর অবস্থিত বিধায় এই নগরীর বিশ্বের সকল দেশের প্রতি এক বিশেষ দায়িত্ব আছে।'
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান উপলক্ষে বঙ্গবন্ধুর এই সফর ছিল অসংখ্য কর্মসূচিতে ঠাসা। সদ্য স্বাধীন একটি দেশের জাতির জনকের আগমনকে কেন্দ্র করে নিউইয়র্ক নগরীর বিদ্বৎসমাজে বিশেষ ঔৎসুক্যের সৃষ্টি হয়েছিল। মনে পড়ে, হোটেল 'ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়া'র রেস্টুরেন্টে খেতে বসেছি। আমার সামনেই উপবিষ্ট একটি পরিবার। পরিচয়ের শুরুতেই তাঁরা আমায় জিজ্ঞেস করেন, 'তুমি কোন দেশ থেকে এসেছ?' আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে তখন তাঁদের মুখে স্বতঃস্ম্ফূর্তভাবে একটি কথাই উচ্চারিত হয়- 'ও, শেখ মুজিব, শেখ মুজিব! তিনি একজন মহান নেতা।' পরিচয় দিয়ে বললাম, আমি তাঁর পলিটিক্যাল সেক্রেটারি। কিন্তু তাঁরা বিশ্বাস করতে পারলেন না। আমার মতো অল্প বয়সী একজন কী করে বিশ্বখ্যাত নেতা শেখ মুজিবের পলিটিক্যাল সেক্রেটারি হতে পারে! কেবল বললেন, 'আর ইউ শিওর?' আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়লাম। তখন তাঁরা বলেছিলেন, 'আমরা মুজিবকে শ্রদ্ধা করি।' তারপর যখন বঙ্গবন্ধুকে আমি ঘটনাটি ব্যক্ত করি, তিনি বললেন, 'তাঁদের নিয়ে এসো।' তাঁদের বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে এলাম। অপার বিস্ময়ে কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে আমাকে অভিবাদন জানিয়ে তাঁরা বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপে মগ্ন হলেন। শুধু বাঙালিদের কাছে নয়, বিদেশিদের কাছেও বঙ্গবন্ধু পরম শ্রদ্ধার আসনে আসীন। যে নেতার জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না; সব রকমের ভয়-ভীতি, লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে জীবন-যৌবনের ১৩টি বছর যিনি কারান্তরালে কাটিয়েছেন; বাঙালির জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে যিনি কোনো দিন আপস করেননি; ফাঁসির মঞ্চে দাঁড়িয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেছেন; বারবার বক্তৃতায় বলেছেন, 'আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি আমার মানুষের অধিকার চাই'; যিনি সারাবিশ্বের নির্যাতিত-শোষিত মানুষের মহান নেতা, তাঁকে বিশ্বনেতারা শ্রদ্ধা ও সম্মানের চোখে দেখবেন- এটাই স্বাভাবিক। জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদপ্রাপ্তির ৪৮ বছর পূর্তির এই বছরটিতে পেছন পানে চাইলে দেখি- কেবল স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই নয়, সেইসঙ্গে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন একটি দেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন, শতাধিক দেশের স্বীকৃতি আদায় এবং আন্তর্জাতিক ফোরাম তথা জোটনিরপেক্ষ সম্মেলন, কমনওয়েলথ, ওআইসি এবং মানবজাতির সর্বোচ্চ পার্লামেন্ট জাতিসংঘে বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তি ও সদস্যপদ অর্জনে বঙ্গবন্ধুর নিরলস কূটনৈতিক প্রচেষ্টা ইতিহাসের পৃষ্ঠায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
তোফায়েল আহমেদ: আওয়ামী লীগ নেতা; সংসদ সদস্য; সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ
tofailahmed69@gmail.com
মন্তব্য করুন