- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- শান্তিময় বিশ্ব গঠনে বাংলাদেশের তাগিদ
সাম্প্রতিক প্রসঙ্গ
শান্তিময় বিশ্ব গঠনে বাংলাদেশের তাগিদ

জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবার ১৯তম বারের মতো ভাষণ দিয়েছেন। এর অর্থ- তিনি বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম অভিজ্ঞতাসম্পন্ন রাষ্ট্রনায়ক। বস্তুত তাঁর বক্তব্যের মধ্যেই আমরা সেই ছাপ দেখতে পাই। একদিকে তিনি বাংলাদেশের স্বার্থে গুরুত্বপূর্ণ সব বিষয় তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন এবং তা কাজে লাগিয়েছেন। একই সঙ্গে তিনি বৈশ্বিক সংকটের বিষয়ও তুলে ধরতে ভোলেননি। বলার অপেক্ষা রাখে না, জাতিসংঘে ভাষণ নিছক কোনো বক্তৃতা নয়; এটি কূটনীতিরও অংশ। এটি এমন একটি মঞ্চ যেখানে বিশ্বের সব দেশের প্রতিনিধিরা থাকেন। বর্তমানে জাতিসংঘ সদস্যভুক্ত দেশ ১৯৩টি। এর মধ্যে ধনী-গরিব, প্রভাবশালী-প্রভাবহীন তথা সব ধরনের রাষ্ট্র রয়েছে। এ সময় বিশ্বের সংবাদমাধ্যমগুলোর চোখও জাতিসংঘের ওপর থাকে। ফলে কে কীভাবে সেখানে বক্তব্য রাখছেন, সেটিও আলোচনার বিষয়।
৩০ মিনিটের ভাষণে প্রধানমন্ত্রী খোলামেলা কথা বলেছেন। তিনি যেভাবে সাহসী উচ্চারণ করেছেন, ঠিক একইভাবে বঙ্গবন্ধুও জাতিসংঘে ভাষণ দিয়েছিলেন। তখন বিশ্বে ছিল স্নায়ুযুদ্ধ। সে সময় ফিদেল কাস্ত্রো, জওহরলাল নেহরুর বক্তব্য নাড়া দিত। পশ্চিমা বিশ্বের ওপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি হতো। তাঁরা বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের মানুষের কল্যাণে কথা বলেছেন। সে জন্য আমরা দেখেছি, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফের মতো বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছে, যারা তৃতীয় বিশ্বের উন্নয়নে ভূমিকা রেখেছে। তখন আমরা দেখেছি দুই মেরুর বিশ্ব। এখন বিশ্বে বহুমেরুর সৃষ্টি হয়েছে এবং পরাশক্তিগুলোর দ্বন্দ্ব এক জটিল রূপ ধারণ করেছে।
জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল সুনির্দিষ্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ কিছু বিষয়ের ওপর। স্বাভাবিকভাবেই তাঁর আলোকপাতকৃত বিষয়গুলোর মধ্যে রোহিঙ্গা ইস্যুটি তাৎপর্যপূর্ণ। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সংকট কেবল বাংলাদেশের বিষয়ই নয়; এটি আন্তর্জাতিক সংকট। এরপরও বলা চলে, বাংলাদেশ একাই এ সমস্যা মোকাবিলা করছে। ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বাংলাদেশে। ২০১৭ সাল থেকে জাতিসংঘে বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ওপর জোর দিয়ে আসছে। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনকে নিয়ে আলোচনা সত্ত্বেও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি। মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা সংকট যেভাবে দীর্ঘায়িত হচ্ছে তাতে সংকট আরও বাড়ছে। কেবল বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনীতি কিংবা পরিবেশের জন্যই সমস্যা নয় বরং রোহিঙ্গাদের কারণে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সংকটও তৈরি হয়েছে।
মানব পাচার, মাদক চোরাচালানের পাশাপাশি আন্তঃসীমান্ত অপরাধ, এমনকি শেষ পর্যন্ত উগ্রবাদেও জড়িত হতে পারে তারা। সে জন্য প্রধানমন্ত্রী এ সংকট সমাধানে যেভাবে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন সেটি জরুরি ছিল।
প্রধানমন্ত্রী প্রাসঙ্গিকভাবেই জাতিসংঘে তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টিও তুলে ধরেছেন। বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। গত এক দশকে আমাদের দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে নেমে এসেছে। আমাদের মাথাপিছু আয় মাত্র এক দশকে তিন গুণ বেড়ে ২ হাজার ৮২৪ মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। আমরা দেখেছি, কভিড ১৯-এর প্রভাব যে গুটি কয়েক দেশ সফলভাবে সামাল দিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।
প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের সংকট নিয়ে যেভাবে কথা বলেছেন, এমন জোরালো, দূরদর্শী ও সাহসিকতার সঙ্গে বিশ্বের খুব কম দেশই কথা বলতে পারে। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রীর কণ্ঠে বিশ্ববাসীর উদ্বেগই ধ্বনিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ইউক্রেন যুদ্ধের বিষয়টি সামনে এনেছেন ভিন্নভাবে। যুদ্ধটি ইউরোপে হলেও এর প্রভাব যে সারাবিশ্বের ওপর পড়ছে তা প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। বৈশ্বিক চলমান অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি সংকট, বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি কিংবা মূল্যস্ম্ফীতিতেও এর প্রভাব পড়েছে। এ সংকটে বিশ্বের সাপ্লাই চেইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডলারের সংকটও এর বাইরে নয়। এ যুদ্ধের কারণে উন্নয়নশীল বিশ্ব ক্ষতিগ্রস্ত হলেও তাদের কোনো দায় নেই। এ সংকটের রেশ টেনে প্রধানমন্ত্রী যে কথাটি বলেছেন সেটি গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেছেন, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তাপ্রার্থী ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আরও প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে। বর্তমানে আমরা এমন একটি সংকটময় সময় অতিক্রম করছি, যখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা আবশ্যক।
প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘে যুদ্ধের বিপরীতে শান্তিময় বিশ্বের ওপর জোর দিয়েছেন। বিশ্বের কাছে তিনি দ্ব্যর্থকণ্ঠে বলেছেন, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ছাড়া আর্থসামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মতো বৈরী পন্থা কখনও কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে দুঃখ-কষ্ট-দুর্দশা হয় তা অবর্ণনীয়। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্বের তাগিদ এবং যুদ্ধ ও অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধের যে আকুতি তাঁর কণ্ঠে ঝরেছে তা বিশ্ব সম্প্রদায় অনুধাবন করবে বলে আমাদের প্রত্যাশা। বলা চলে, তিনি সরাসরি পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করেছেন। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে যে নারী ও শিশুরাও সংকটে পড়ছে সেটিও তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ব বিবেকের কাছে অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ ও নিষেধাজ্ঞা বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।
জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী সার্থকভাবে আলোকপাত করেছেন। আমরা জানি, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ভুক্তভোগী দেশগুলোর অন্যতম। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশের অবনতির পেছনে দায়ী উন্নত বিশ্ব এবং শিল্পোন্নত দেশগুলো। তাদের গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণের কারণে আমরা ঝুঁকিতে। তারা সে জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কথা বললেও তা পূরণে সেভাবে এগিয়ে আসছে না, সেটিই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন। তিনি বলেন, মানবজাতির জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব। জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।
বস্তুত জাতিসংঘের ভাষণের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নিজেকে কেবল বাংলাদেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ না রেখে যেভাবে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে কথা বলেছেন; এর মাধ্যমে বিশ্বব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হিসেবে নিজেকে প্রমাণ করেছেন। তাঁর ভাষণ শান্তি ও মানবতার এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল বলে আমি মনে করি। তিনি ভাষণের মাধ্যমে বিশ্ব শান্তির জন্য যে রোডম্যাপের রূপরেখা অঙ্কন করেছেন সেটি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
সংকট ও বিরোধ নিষ্পত্তিতে পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার যে নির্দেশনার কথা তিনি বলেছেন সেটিই বর্তমানে জরুরি। বিশ্ব সম্প্রদায় তাঁর ভাষণ আমলে নিয়ে একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব গঠনে এগিয়ে আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন