ঢাকা মঙ্গলবার, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩

সমকালীন প্রসঙ্গ

ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার: সম্ভাবনা ও শঙ্কা

ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার: সম্ভাবনা ও শঙ্কা

তাসনিম সিদ্দিকী

প্রকাশ: ২৮ অক্টোবর ২০২২ | ১২:০০ | আপডেট: ২৮ অক্টোবর ২০২২ | ১৪:৩৯

সম্প্রতি ব্রুনাইয়ের সুলতান হাজি হাসানাল বলকিয়াহ মুইজ্জাদ্দিন ওয়াদৌল্লাহ বাংলাদেশে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে এসেছিলেন। সফরকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর দ্বিপক্ষীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। উভয় দেশের শীর্ষ নেতার এ বৈঠক সফল বলেই সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। সত্তর ও আশির দশকে ব্রুনাই বাংলাদেশের জনশক্তির বড় বাজার ছিল। নব্বইয়ের দশক থেকে ক্রমে বাজারটি সংকুচিত হতে থাকে। ১৫ থেকে ১৭ অক্টোবর ব্রুনাইয়ের সুলতানের সফরকালে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের পর দু'দেশের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।

বঙ্গভবনে সৌজন্য সাক্ষাৎকালে রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ দুই মুসলিম দেশের বৃহত্তর সুবিধার্থে বাংলাদেশ থেকে আরও অধিক হারে জনবল নিয়োগের জন্য ব্রুনাইয়ের সুলতানের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি ব্রুনাইয়ের ব্যবসায়ীদের বাংলাদেশে বিনিয়োগেরও আহ্বান জানান। সুলতানের প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সফরে ভ্রাতৃপ্রতিম দুই দেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হলো। বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নকে গুরুত্ব দেয়।

শ্রম অভিবাসন বাংলাদেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। প্রতি বছর ৬-৭ লাখ অদক্ষ নাগরিক কাজের জন্য বিদেশে যান। বলা হয়, আমরা ১০০টির বেশি রাষ্ট্রে জনশক্তি পাঠাই। আসলে মধ্যপ্রাচ্যের ১৩টি রাষ্ট্র ঘিরে গড়ে উঠেছে আমাদের শ্রমবাজার। এসব অদক্ষ জনশক্তি ঘুরেফিরে এ ১৩টি দেশেই যাচ্ছে। অদক্ষ জনশক্তি না পাঠিয়ে দক্ষ জনশক্তি পাঠানো গেলে রেমিট্যান্সের হার হতো বহুগুণ। ১৩টি দেশের কথা বলা হলেও সবসময় দেখা যায় শ্রমবাজারটি একক কোনো দেশে কেন্দ্রীভূত। অর্থাৎ যে কোনো একটি দেশে অনেক বেশি অভিবাসন হয়। যেমন- সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, দুবাই প্রভৃতি।

প্রতি বছর আমাদের অভিবাসী কর্মীরা ২০-২১ বিলিয়নের মতো বৈদেশিক মুদ্রা দেশে পাঠান। আমাদের বৈদেশিক রিজার্ভের অর্ধেকের বেশিই গড়ে ওঠে তাঁদের পাঠানো রেমিট্যান্সে। এ বছর কোনো কোনো মাসে রেমিট্যান্সের হার সর্বনিম্ন পর্যায়ে চলে গেছে। বিষয়টি নিয়ে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক চিন্তিত। এর চেয়ে বেশি চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ব্যাপকভাবে কমে যাচ্ছে। বিভিন্ন পর্যায়ের নীতিনির্ধারকরা বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছেন এবং কী উপায়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো যায়, সেসব পদক্ষেপের দিকে অগ্রসর হচ্ছেন। অভিবাসনের জন্য নতুন বাজার খোলা রেমিট্যান্স বাড়ানোর অন্যতম কৌশল। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে, যাতে নতুন বাজার খোলা সম্ভব হয়।

ব্রুনাইয়ের সুলতানের বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় সফর নতুন বাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে এক ধাপ অগ্রগতি বলা যায়। করোনার আঘাত ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের সময় ব্রুনাইয়ের সুলতানের বাংলাদেশ সফরটি আমাদের জন্য বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। আগেই বলেছি, একসময় ব্রুনাইয়ে প্রচুর লোক কাজের উদ্দেশ্যে যেত। কিন্তু বেশ কিছু বছর ধরেই এটি আর বাংলাদেশের তেমন কোনো গুরুত্বপূর্ণ শ্রমবাজার হিসেবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সুলতানের ঢাকা সফরকালে যে দুটি বিষয় গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরা হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশ ব্রুনাই থেকে জ্বালানি আমদানি করতে এবং ব্রুনাইয়ে আগের মতো জনশক্তি পাঠাতে আগ্রহী। শ্রমশক্তি গ্রহণের বিষয়টিতে ব্রুনাইয়ের সুলতান ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করেছেন; একই সঙ্গে বাংলাদেশ থেকে আমিষজাতীয় পণ্য (মাছ-মাংস) আমদানির ব্যাপারে উৎসাহ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ ও ব্রুনাইয়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শ্রম অভিবাসনের বিষয়টি তুলে ধরেছেন এবং ব্রুনাইয়ের সুলতানের প্রতিশ্রুতি গ্রহণে সফল হয়েছেন। এর মাধ্যমে আমাদের প্রধানমন্ত্রী তাঁর দায়িত্ব যথাযথভাবে সম্পন্ন করেছেন। এখন সংশ্নিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব হচ্ছে প্রথমে মন্ত্রী; পরে আমলা ও ব্যবসায়ী পর্যায়ে ব্যাপক আলাপ-আলোচনার পাশাপাশি দর-কষাকষি চালিয়ে যাওয়া। যাতে ভালো শর্তে আমরা ব্রুনাইয়ের বাজারে বাংলাদেশি কর্মীদের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করতে পারি।

আগে ব্রুনাইয়ের বাজার ছিল পুরুষকেন্দ্রিক। এখানে নারী অভিবাসনের ক্ষেত্র রয়েছে কিনা, দেখতে হবে। একসময় প্রচুর পেশাজীবী কর্মী ব্রুনাইয়ে কাজ করতে যেতেন। চিকিৎসক, প্রকৌশলীর পাশাপাশি দক্ষ জনশক্তির কদর ছিল সেখানে। বাংলাদেশের কর্মীরা মূলত সে দেশে হিসাব ও ব্যবস্থাপনা বিভাগে কাজ করতেন। এবারও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হবে যেন দক্ষ জনশক্তির জন্য বাজার উন্মুক্ত করতে পারি। তবে ব্রুনাইয়ে গার্মেন্ট ও শিল্পকারখানা নেই। ফলে যেসব শ্রমিক সে দেশে কাজ করছেন, তাঁরা মূলত গ্যাস উত্তোলন ও সরবরাহ, গাড়ি মেরামতসহ বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত।

এখন বেশি প্রয়োজন ব্রুনাইয়ের শ্রমবাজার নিয়ে গবেষণা করা। সেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে কর্মী প্রয়োজন তার একটি মূল্যায়ন করা দরকার। শুধু মূল্যায়ন করে থেমে থাকলে হবে না; সে অনুযায়ী সরকারের যে টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার (টিটিসি) রয়েছে, সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলতে হবে। এ ক্ষেত্রে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে কাজ করা যেতে পারে। শিক্ষানবিশ ও পুরোনোদের দ্রুত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। ব্রুনাইয়ে নারী অভিবাসনের নিরাপদ ক্ষেত্রগুলো খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

বাংলাদেশ-ব্রুনাইয়ের সম্পর্ক শুধু যে শ্রম অভিবাসীদের জন্য নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে, তা নয়; ব্রুনাইয়ের সুলতান এ দেশ থেকে মাছ-মাংস আমদানির আগ্রহ ব্যক্ত করায় বাণিজ্যিক সম্পর্কও সৃষ্টি হবে। গৃহপালিত পশুপালন ও মাংস রপ্তানির সঙ্গে জড়িতরাও লাভবান হবেন। তাঁরা রপ্তানির নতুন বাজার পেতে যাচ্ছেন। যে কোনো এনজিও ও বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা শ্রম অভিবাসনকে আমিষজাতীয় পণ্য রপ্তানির সঙ্গে যুক্ত করে নিতে পারবেন। অভিবাসন ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক জোরদারে পররাষ্ট্র, প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয় যৌথভাবে কাজ শুরু করতে পারে।

এটাও মনে রাখা দরকার, অতীতে দেখা গেছে, সর্বোচ্চ পর্যায়ে আলাপ-আলোচনায় বিভিন্ন দেশের বাজার উন্মোচিত হলেও অল্প সময়ের মধ্যেই ওই দেশে এবং বাংলাদেশে একটি অসাধু চক্র গড়ে ওঠে। তারা শ্রম অভিবাসন কার্যক্রমে অসাধু উপায় অবলম্বন করে বিষয়টিকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এতে অভিবাসীদের অভিবাসন থেকে যে ফল পাওয়ার কথা অথবা রাষ্ট্র যে পরিমাণ রেমিট্যান্স-সমৃদ্ধ হতে পারত, তা হয়ে ওঠে না। বরং আমরা দেখি উচ্চ অভিবাসন মূল্য দিয়ে কর্মীরা বিদেশে গিয়ে রাস্তাঘাটে অবস্থান করছেন। কাজ না পেয়ে অনাহার-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন। অনেকে দেশের বাড়ি থেকে টাকা নিয়ে জীবন বাঁচাচ্ছেন। এক পর্যায়ে অভিবাসন-রাষ্ট্র বিরক্ত হয়ে বাংলাদেশ থেকে শ্রম অভিবাসনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে বসে। আমরা আশা করব, বাংলাদেশ সরকার বিষয়টির ওপর নজর দেবে এবং অভিবাসীদের কাজের মান, যথাযথ মজুরি, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করবে।

অধ্যাপক ড. তাসনিম সিদ্দিকী: চেয়ারপারসন, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, রামরু

আরও পড়ুন