- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বিচারের দাবি এবং রাষ্ট্রের স্বভাব-চরিত্র
আইন-আদালত
বিচারের দাবি এবং রাষ্ট্রের স্বভাব-চরিত্র

জগৎসংসারে বাদীর সংখ্যাই বেশি; বিবাদীর তুলনায়। বিবাদীরাও আবার বাদী হয়; ঘটনাক্রমে। কারণ সংসার অন্যায়ে ভরপুর। সব বাদী আদালতে যায় না। অনেকেই অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে। কেউ-কেউ আশা করে প্রকৃতি কিংবা পরকালের বিচারের ওপর। হয়তো এমনও ভাবে, একদিন তারও সুযোগ আসবে। প্রতিহিংসার রক্তাক্ত ঘটনা আগেও ঘটেছে, এখনও ঘটে। লোকে আদালতে যেতে চায় না, কারণ জায়গাটা রহস্যময়। সেখানকার তৎপরতা আদৌ নির্ভরযোগ্য নয়; আর যাওয়াটা কঠিন। একবার ঢুকলে বের হয়ে আসাটা যে সহজ, তাও নয়। তা ছাড়া আদালত নিষ্ঠুরও হয়। কতটা যে নিষ্ঠুর হতে পারে টের পায় তা ভুক্তভোগী। বিশেষ করে রাষ্ট্র যদি প্রতিপক্ষ হয়। বিচারালয়কে বলা হয় অন্ধ। অর্থাৎ নিরপেক্ষ, পক্ষপাতহীন। তার হাতে যে দাঁড়িপাল্লা আছে; দু'দিক তার কাছে সমান। কোনদিকে যে ঝুঁকবে- নির্ভর করে তথ্যপ্রমাণ, আইনকানুন, যুক্তি-তর্ক ইত্যাদির ওপর। বলা হয়, আইনের শাসন যেখানে শেষ; অত্যাচারের সেখানে শুরু। অথচ সাহিত্য, চলচ্চিত্র, ইতিহাস, বাস্তব জীবনে ঘন ঘন শোনা যায় বিচারের জন্য আর্তকণ্ঠে প্রার্থনা। কানে বাজে আদালতের প্রতি উচ্চারিত ধিক্কার ধ্বনি। মামলায় মীমাংসা যত না হয়, তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি হয় হার-জিত। যে হারে, সে-ও জিততে চায়। পারলে পাল্টা মামলা করে। আদালতে স্তূপ হয়ে পড়ে থাকে বিচারাধীন মামলার নথিপত্র।
আমরা তো দেখতেই পাই, আদালতে যেতে হলে অনেক কাঠখড় পোড়াতে হয়। কোর্ট ফি লাগে, উকিল চাই, সাক্ষী-সাবুদ দরকার পড়ে; কাগজপত্র, নথি-দলিল সাজাতে হয়। তারপর একবার আদালতে ঢুকলে কবে যে বের হওয়া যাবে, তা অনিশ্চিতই থেকে যায়। উকিল ও বিচারক উভয়েই কালো পোশাক পরে থাকেন। যেন ভয় দেখাচ্ছেন আইন ভঙ্গকারীদের। কিন্তু ভয় পেয়ে যান বিচারপ্রার্থীরাও। এমনকি ন্যায়বিচার পেলেও এমন শঙ্কা থাকে- প্রতিপক্ষ আরও উচ্চ আদালতে রওনা দেবে। টাকার জোর থাকলে তো রওনা দেবেই। টাকার জোরটা অন্যত্র যেমন, এখানেও তেমনি আস্ত ও মস্ত। উকিল সাহেবরা টাকা ছাড়া এক পা নড়েন না। তাঁরা ন্যায়-অন্যায় চেনেন না; টাকা চেনেন। আদালত নিজেও যে টাকার স্পর্শ এড়াতে পারবেন- এ বিষয়েও নিশ্চিত হওয়ার উপায় নেই।
খুব বড়মাপের দার্শনিক ও লেখক ছিলেন ফ্রান্সিস বেকন; ইংল্যান্ডের সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বিচারকের আসন পেয়েছিলেন তিনি এক সময়। ঠিক সেই সময়েই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল উৎকোচ গ্রহণের। বিচারে তাঁর কারাদণ্ড হয় এবং পরে তিনি স্বীকারও করেন যে বিচারটা ন্যায়সংগতই ছিল। অত বড় দার্শনিক যদি উৎকোচের লোভ সংবরণ করতে অপারগ হন, তবে আইনের শাসনের ব্যাপারে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত না হয়ে উপায় কী?
ন্যায়বিচারের আরও অনেক সমস্যা আছে, যার খবর শেকস্পিয়রের নাটকেই পাওয়া যাবে। যেমন তাঁর মেজার ফর মেজার নাটকে। সেখানে তরুণ এক বিচারককে দেখা যাচ্ছে অত্যন্ত 'ন্যায়পরায়ণ' ব্যক্তি হিসেবে। আইন ছাড়া কিছু বোঝে না। আইনের বিধান অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে চায়। কিন্তু তার আদালতে তরুণী নায়িকা এসে বিচার প্রার্থনা করলে আদালতে বসেই সে ইঙ্গিত করে যে ঘুষ দিতে হবে। আর সে ঘুষ অন্যকিছু নয়, নায়িকার সল্ফ্ভ্রম বটে। শেকস্পিয়রের আরেক নাটক মার্চেন্ট অব ভেনিস; সেখানে প্রতিহিংসাপরায়ণ শাইলক তার প্রতিপক্ষ এক ব্যবসায়ীর গা থেকে এক পাউন্ড মাংস কেটে নিতে উদ্যত হয়েছিল। কেননা, বিচারে সেটাই তার প্রাপ্য। অসহায় বিচারক আইনানুগ বিচারের পক্ষে রায় দিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। বিপন্ন ব্যবসায়ীটির প্রাণ বাঁচাল এক তরুণ আইনজীবী। আসলে সে আইনজীবী নয় মোটেই, তীক্ষষ্ট বুদ্ধিসম্পন্না নায়িকা; নাটকের। আইনজীবীর ছদ্মবেশে এসেছে। সে দেখাল- চুক্তির শর্ত অনুযায়ী শাইলক এক পাউন্ড মাংস পাবে ঠিকই, কিন্তু এক ফোঁটা রক্তও ঝরাতে পারবে না। আইনের ওই ব্যাখ্যাতেই বিপন্ন ব্যবসায়ী প্রাণে বাঁচল।
এ রকম দক্ষ আইনজীবী যে বাস্তব ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না, এমন নয়। বাদীকে সাহায্য করার জন্য দক্ষ উকিল সাহেবরা আছেন। তাঁরা সদা প্রস্তুত; এক পায়ে খাড়া। কিন্তু তাঁরা বাদীর যেমন, তেমনি বিবাদীরও। 'আগে এলে আগে পাবেন' নিয়ম তো রয়েছেই। তদুপরি যার পকেটে টাকা অধিক; অগ্রাধিকার তারই- এ নিয়মটাও চালু। উকিলরা নিজেরাই বলেন, তাঁরা আইনজীবী। আইনই তাঁদের জীবিকা। তাঁদেরকে আইন-ব্যবসায়ীও বলা হয়। বললে তাঁরা যে তাতে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করেন, এমন নয়। কখনোই তাঁরা দাবি করেন না যে তাঁরা সেবক অথবা চিকিৎসক। চিকিৎসকের কাজ রোগ সারানো। বিপন্ন রোগীকে সাহায্য করার সুযোগে চিকিৎসকরা যদি টাকা হাতিয়ে নিতে পারেন, তবে আইনজীবীরা কেন ভিন্ন আচরণ করবেন? মামলায় জিত হোক কিংবা হার; তাতে কী যায় আসে? উকিলের কাজ ওকালতি করা। বিচার যা করার করবেন মাননীয় আদালত। উকিলরা হচ্ছেন কৌশলী; ওই নামে তাঁদের ডাকাও হয়, তাঁরা নিজেরাও ওই নাম ব্যবহার করেন। কৌশলী হিসেবে কৌশল প্রয়োগ করেন মক্কেলকে জিতিয়ে দিতে। বলেন, বিচারককে সাহায্য করছেন। আসলে যা করেন তা সাহায্য নয়; প্রভাবিত করা। পারলে বোকা বানানো। নিশানাটা প্রতিপক্ষের যিনি কৌশলী, তিনি নন। নিশানাটা স্বয়ং বিচারক এবং মক্কেলও। মক্কেলকে বোঝানো চাই- কৌশলী যেসব কৌশল প্রয়োগ করছেন, তা অসাধারণ। বোঝাতে পারলে আরও মক্কেল জুটবে এবং চাহিদা বাড়লে দাম চড়বে। আইন কি গাধা? এ প্রশ্ন যখন ওঠে তখন পেছনে এমন জ্ঞান হয়তো থাকে যে আইনকে গাধা বানানো যায়। এমনকি তাকে ভারবাহী পশুতে পরিণত করাও চলে। আদালতে ওই দুই চেষ্টা সমানে চলতে থাকে। আদালতের কালো পোশাকে বিচারপ্রার্থীদের বুক কাঁপে। আর আদালতের ভাষা? বাংলাদেশে উচ্চ আদালতের ভাষা আজও কেন বাংলা হলো না- এ কথা বলতে বলতে আমাদের গলায় ব্যথা ধরে গেছে। না-হওয়ার একটা কারণ হয়তো বহুদিনের অভ্যাস এবং ঔপনিবেশিক ঐতিহ্য। অন্য একটি কারণ কিন্তু বিচারপ্রার্থীদের কাছে দুর্বোধ্য থাকা। যত দুর্বোধ্য থাকা যাবে ততই দাম বাড়বে। চিকিৎসার ক্ষেত্রে যেমনটা ঘটে; ঘটে ধর্মের শাস্ত্রীয় অনুষ্ঠানের বেলাতে। উচ্চ আদালতের ভাষা যদি বাংলাও হয় তবে সে বাংলা সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার মতো সরল হবে- এমন আশায় জলাঞ্জলি দিয়ে রাখাই ভালো। আদালতের ভাষা আদালতের পোশাকের মতোই অন্ধকারাচ্ছন্ন থাকতে পছন্দ করে; রহস্যময় হয়ে থাকতে চায়। সহজবোধ্য হতে তার দারুণ অনিচ্ছা, পাছে সে সহজলভ্য হয়ে পড়ে; আইন ব্যবসা বিপর্যস্ত হয়; উকিল-মোক্তার, পাইক-পেয়াদা এবং বিচারকরা সবাই তাঁদের 'অসাধারণত্ব'টা খুইয়ে ফেলেন। আইন ঘোরপ্যাঁচের ব্যাপার। সে যে গাধা নয়- সেটা প্রমাণ করতে চায় বিচারপ্রার্থীদের গাধা বানিয়ে; বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিয়ে। এ রকম কথা তো চালুই আছে- আইনজীবীর হাতে পড়া পুলিশের হাতে পড়ার চাইতেও বিপজ্জনক। পুলিশ আইন দেখালে হয়তো ছেড়ে দেবে। কিন্তু আইনজীবী মক্কেলকে আইন দেখিয়ে লড়াইয়ের ময়দান থেকে সহজে সরতে দেবে না। উদ্বুদ্ধ করতেই থাকবে। এ ব্যাপারে দু'পক্ষের আইনজীবীদের ভেতর একটি অলিখিত পেশাগত চুক্তিই রয়েছে; যে-চুক্তি মোটেই বেআইনি নয়; পুরোপুরি আইনসম্মত।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন