- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কতটা এগোলাম?
সমাজ
নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে কতটা এগোলাম?

আজ আন্তর্জাতিক নারী নির্যাতন প্রতিরোধ দিবস। আবার আজই শুরু হচ্ছে লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার বিরুদ্ধে ১৬ দিনের বৈশ্বিক বিশেষ প্রচারণা। বলাবাহুল্য, নারীর প্রতি সহিংসতা বৈশ্বিক সংকট। সে জন্যই আমরা নারীর অধিকার বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধে বৈশ্বিক অনেক উদ্যোগ দেখেছি। ১৬ দিনের বিশেষ এ প্রচারণাও তার বাইরে নয়। এ ছাড়াও কয়েকটি তৎপরতা বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে। প্রথমত, ১৯৯৫ সালের 'বেইজিং প্ল্যাটফর্ম ফর অ্যাকশন' বা বেইজিং ঘোষণায় নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধ যে মানবাধিকার, তা নীতির জায়গা থেকে প্রথম দেখানো হয়। সেখানে সহিংসতা প্রতিরোধকে সামাজিক মূল্যবোধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নারীর নিরাপত্তার বিষয়টিও সেখান গুরুত্বের সঙ্গে এসেছে। বৈশ্বিক তৎপরতার ক্ষেত্রে দ্বিতীয় যে বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ, সেটি জাতিসংঘ মহাসচিবের উদ্যোগ। ২০০৬ সালের অক্টোবরে 'সেক্রেটারি জেনারেল'স ইন-ডেপথ স্টাডি অন অল ফর্মস অব ভায়োলেন্স এগেইনস্ট উইম্যান' শিরোনামে একটি গবেষণা প্রকাশ হয়। সেখানে বিশেষ করে নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতায় তথ্যের বিষয়টিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এখানে স্বাভাবিকভাবেই তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। সেই সূত্র ধরেই আমাদের পরিসংখ্যান ব্যুরো তা নিয়ে কাজ করেছে। ২০০৬ সালের উদ্যোগে রাজনীতিকদের ভূমিকাও সেখানে বড় করে দেখানো হয়েছে। সবার অংশগ্রহণে সহিংসতা প্রতিরোধের বিষয়টি এসেছে সেখানে।
তৃতীয় যে বিষয়টি আন্তর্জাতিক উদ্যোগ হিসেবে উল্লেখযোগ্য, সেটি হলো ২০১৫ সালে নেওয়া এসডিজি-টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা। সেখানে দুটি ধারা নারীর প্রতি সহিংসতা সংক্রান্ত। লক্ষ্যমাত্রা ৫.২-এ বলা হয়েছে- 'পাচার, যৌন হয়রানি ও অন্যান্য ধরনের শোষণ-বঞ্চনাসহ ঘরে-বাইরে সব নারী ও মেয়ের বিরুদ্ধে সব ধরনের সহিংসতার অবসান। আর লক্ষ্যমাত্রা ১৬.১; সর্বত্র সব ধরনের সহিংসতা ও সহিংসতাজনিত মৃত্যুহার উল্লেখযোগ্য হারে কমিয়ে আনা এবং ১৬.২; শিশুদের বিরুদ্ধে সব রকম সহিংসতা, নির্যাতন ও শোষণ এবং শিশু পাচারের মতো ঘৃণ্য তৎপরতার অবসান।'
এ সহিংসতা বন্ধে সাম্প্রতিক বৈশ্বিক তৎপরতা হিসেবে ২০১৯ সালের নাইরোবি সম্মেলন গুরুত্বপূর্ণ। ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন পপুলেশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-আইসিপিডির ২৫ বছর পূর্তিতে ২০১৯ সালে ওই কনফারেন্সের কর্মপরিকল্পনা 'থ্রি জিরো এজেন্ডা' গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে তৃতীয় বিষয়টি হলো লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা সম্পূর্ণরূপে দূরীকরণ। লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা রোধে বৈশ্বিক এ উদ্যোগগুলোই প্রমাণ করে, বিষয়টি কত গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে আমরা দেখেছি, কভিড-১৯ এর সময়েও নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতা বেড়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা একটা সমাজে এভাবে চলতে পারে না। এটি এক ধরনের মানবাধিকারের লঙ্ঘন। সামাজিক ন্যায়বিচারের দিক থেকে চিন্তা করলেও এটি অবশ্যই বন্ধ হওয়া উচিত। সহিংসতা নারীর অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এবং সমাজের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণের প্রতিবন্ধক। এমনিতেই বাংলাদেশে নারীর অংশগ্রহণ অর্থনীতিতে ব্যাপকভাবে হয়নি। তার ওপর সহিংসতা নারীকে তথা সার্বিকভাবে সমাজকে পিছিয়ে দিচ্ছে। তা ছাড়া নারীর স্বাস্থ্যের ওপরেও সহিংসতার বড় প্রভাব রয়েছে। এটা অনেকের জন্য এক ধরনের ট্রমা। যে ট্রমা পরবর্তী প্রজন্মকেও প্রভাবিত করতে পারে।
প্রশ্ন হলো, নারীর প্রতি সহিংসতার সূচকগুলো কী। তাঁরা কোথায় কোথায় সহিংসতার শিকার হন? নারী অনেকে যেমন গৃহে এর শিকার, তেমনি কর্মস্থল এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও সহিংসতার কবলে পড়েন। তা ছাড়া জনপরিসর বিশেষ করে গণপরিবহনও অনেক ক্ষেত্রে নারীর জন্য নিরাপদ নয়। আমাদের দেখতে হবে, একজন নারী কীভাবে এবং কী মাত্রায় আক্রান্ত হন। কতটা আক্রান্ত হচ্ছেন, সে তথ্যটা গুরুত্বপূর্ণ। কারণ সেভাবে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। আমাদের তথ্যে অনেক সময় গরমিল দেখা যায়। আবার শহরের তথ্য এলেও গ্রামের তথ্য সেভাবে আসছে না। তা ছাড়া তথ্যের ক্ষেত্রে সময়টা বোঝাও জরুরি। নারী সহিংসতার শিকার হওয়ার পর তার বিস্তারিত জানা প্রয়োজন। কীভাবে তিনি সহিংসতার শিকার হলেন এবং সে অনুযায়ী ত্বরিত ব্যবস্থা না নেওয়ার কারণে অনেক সময় আলামত নষ্ট হয় কিংবা অপরাধী ছাড় পাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়। প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের ক্ষেত্রেও সে দুর্বলতা স্পষ্ট। সর্বক্ষেত্রে সঠিক তথ্য গুরুত্বপূর্ণ। অথচ নারীর প্রতি সহিংসতার ক্ষেত্রে সেই তথ্যে অনেক 'গ্যাপ' আমরা দেখছি। বাড়িতে এবং বিশেষ করে নারীর 'পার্টনার' দ্বারা সহিংসতার যেমন তথ্য রয়েছে, সে তুলনায় কর্মক্ষেত্র, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জনপরিসর কিংবা গণপরিবহনে সহিংসতার তথ্য কম রয়েছে। একইভাবে বিবাহিত নারীর ওপর সহিংসতার তথ্য বেশি থাকলেও অন্যদের ওপর তথ্য সীমিত। কিশোরী কিংবা বৃদ্ধ নারীরাও যে সহিংসতার শিকার, সে তথ্যে যথেষ্ট গ্যাপ রয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতায় সামাজিক ধ্যান-ধারণা বোঝা জরুরি। যাঁরা সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করেন তাঁরা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন, আবার রাষ্ট্রীয় যেসব প্রতিষ্ঠান রয়েছে, তাদের মনোভাবও বোঝা দরকার। নারী কেন সহিংসতার শিকার হন, তার মূল কারণগুলোও বের করা দরকার। নারীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ কেন ৩৬-৩৭ শতাংশে আটকে আছে, সেটা তদন্ত করলেও দেখা যাবে সহিংসতার প্রভাব সেখানে রয়েছে। নারীর প্রতি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক মূল্যবোধ জাগ্রত করাও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
নীতিগত বিষয় হিসেবে সহিংসতা প্রতিরোধে পদক্ষেপ নিতে গেলে সঠিক যৌন শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে। অস্বীকার করা যাবে না, আইনগত দিক থেকে নারীর সুরক্ষায় আমাদের উদ্যোগ যথেষ্ট। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে আইন যথেষ্ট শক্তিশালী। সম্প্রতি আমরা দেখেছি, আদালতের অনুমতি ছাড়া ধর্ষণ বা ধর্ষণচেষ্টা মামলায় জেরার সময় ভুক্তভোগীকে তাঁর চরিত্র ও অতীত যৌন আচরণ নিয়ে প্রশ্ন করা যাবে না- এমন বিধান যুক্ত করে ঔপনিবেশিক আমলের সাক্ষ্য আইনের সংশোধনী জাতীয় সংসদে পাস হয়েছে। সহিংসতার শিকার হওয়ার পর যদি নারীকেই জেরা করা হয়; সেটি দুঃখজনক। সে জন্য নারীবান্ধব প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা এবং যাঁরা সেখানে কাজ করেন তাঁরা যাতে নারীর প্রতি সহানুভূতিশীল হন, তা নিশ্চিত করা চাই। ইন্টারনেটের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে সাইবার অপরাধও বেড়েছে। নারী সেখানে নানাভাবে সহিংসতার শিকার হন। সুতরাং নারীর সাইবার সুরক্ষা বাড়াতে আরও পদক্ষেপ নেওয়া চাই।
আমি বলতে চাই, যে কোনো ক্ষেত্রে তথ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নারীর প্রতি সহিংসতার তথ্যে যথেষ্ট ঘাটতি থাকলেও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) উদ্যোগের প্রশংসা করতেই হবে। বিবিএস প্রথমবারের মতো ২০১১ সালে প্রথমবার নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ করেছে। এর পর বিবিএস জরিপ করে ২০১৫ সালে। তবে সহিংসতার একেবারে গোড়ার কারণগুলো বের করে আনতে বিশেষভাবে জরিপ করা যেতে পারে। একই সঙ্গে মনিটরিংটাও এ ক্ষেত্রে জরুরি। ২০২২ সালে আমরা যে আলোচনা করছি, ২০২৫ সাল কিংবা ২০৩০-এ যদি একই আলোচনা করি, তা তো হতে পারে না। এ আট বছরে আমরা কতটা এগোলাম, তাও দেখা দরকার। আমরা পিপিআরসি ইউএনএফপিএর সঙ্গে একটা ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করাচ্ছি, যাতে মনিটরিংটা নিশ্চিত করা যায়। এটা সরকারিভাবে হলে নিশ্চয় আরও ভালো ফল পাওয়া সম্ভব এবং সামষ্টিক উদ্যোগও নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করবে বলে আমার বিশ্বাস।
ড. হোসেন জিল্লুর রহমান: অর্থনীতিবিদ ও এক্সিকিউটিভ চেয়ারম্যান, পিপিআরসি
মন্তব্য করুন