- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- বিএনপির ঢাকা সমাবেশ ঘিরে সংগত সংশয়
রাজনীতি
বিএনপির ঢাকা সমাবেশ ঘিরে সংগত সংশয়

কী হতে যাচ্ছে আগামী ১০ ডিসেম্বর? জনমনে এ প্রশ্ন এখন বেশ জোরেশোরেই ধাক্কা দিচ্ছে। বিরাজ করছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ওইদিন বিএনপির পূর্বঘোষিত ঢাকা বিভাগীয় গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা। কিন্তু বিএনপি এবং ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতাদের সাম্প্রতিক কথাবার্তায় সংশয় সৃষ্টি হয়েছে দিনটি ভালোয় ভালোয় পার হবে কিনা।
১০ ডিসেম্বর তারিখটি আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে এসেছে বিএনপি নেতা আমানউল্লাহ আমানের সাম্প্রতিক একটি উক্তির পর। তিনি বলেছেন- ১০ ডিসেম্বরের পর দেশ চলবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে। প্রশ্ন জেগেছিল তখনই, কীভাবে খালেদা জিয়ার নির্দেশে দেশ চলবে? তিনি এখন বন্দিজীবন কাটাচ্ছেন। যদিও সরকারের অনুমোদনে অবস্থান করছেন কারাগারের বাইরে; নিজের বাসায়। যেসব শর্তে খালেদা জিয়া কারাগারের বাইরে থাকার অনুমতি পেয়েছেন, তার অন্যতম একটি হলো তিনি রাজনৈতিক কোনো কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারবেন না, কথাও বলতে পারবেন না। সেসব শর্ত খালেদা জিয়া সুচারুরূপে পালন করে যাচ্ছেন। ২০২০ সালের ২৫ মার্চ থেকে আজ পর্যন্ত রাজনীতি নিয়ে তিনি একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি। বিএনপি নেতারা সময়ে সময়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গেলেও তিনি দল বা রাজনীতি নিয়ে কথা বলেছেন- এমন বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে আসেনি। প্রশ্ন হলো, যিনি তাঁর দলকেই দৃশ্যত কোনো নির্দেশ দিচ্ছেন না; তিনি কীভাবে দেশ পরিচালনার নির্দেশ দেবেন?
হতে পারে, আমানউল্লাহ আমানের ওই উক্তি ছিল আবেগের বহিঃপ্রকাশ এবং কর্মীদের উজ্জীবিত করার কৌশল। তবে কখনও কখনও কৌশল বুমেরাং হয়ে দেখা দিতে পারে বৈকি। ১০ ডিসেম্বর সামনে রেখে সরকারের শক্ত অবস্থান সম্ভবত সেই বুমেরাংয়েরই ফসল। সরকার পক্ষ ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছে, বিএনপিকে আর ছাড় দেওয়া হবে না, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তারা মাঠে নামবে। যদিও বিএনপি বলেছে, তারা ওইদিন ঢাকায় স্মরণকালের বৃহৎ জনসমাগম ঘটিয়ে সরকারের পতন-আন্দোলনকে চূড়ান্ত রূপ দেবে।
ইতোমধ্যে বিএনপি ১০ ডিসেম্বরের গণসমাবেশের জন্য পুলিশের 'অনুমতি'র আবেদন জমা দিয়েছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের দপ্তরে। যদিও রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশের জন্য পুলিশের অনুমতি নেওয়ার কোনো প্রয়োজন সংবিধানের আলোকে প্রয়োজনীয় নয়। কেননা, সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে দেশের যে কোনো নাগরিকের সভা-সমাবেশ-মিছিলে অংশ নেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে; যদি তা যুক্তিসংগত কারণে প্রণীত কোনো আইনের দ্বারা বিধিনিষেধের আওতায় না পড়ে। প্রথা অনুযায়ী রাজনৈতিক দলগুলো যে স্থানে সভা-সমাবেশ করতে ইচ্ছুক, সে স্থানের তত্ত্বাবধানকারী কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তা ব্যবহারের অনুমতি নেবে। তবে শান্তিশৃঙ্খলা রক্ষা এবং কোনোরকম অনাহূত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সতর্কতা হিসেবে বিষয়টি পুলিশকে অবহিত করে রাখতে পারে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্যি, দীর্ঘদিন ধরে দেশে সংবিধানের এই ধারাকে উপেক্ষা করা হচ্ছে। 'যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ সাপেক্ষে' কথার বাতাবরণে রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশকে পুলিশ-প্রণীত আইনের একটি ধারায় শৃঙ্খলিত করে রাখা হয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালত রাজনৈতিক দলের সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা সংক্রান্ত পুলিশ অধ্যাদেশের ২৯ ধারা কেন সংবিধান পরিপন্থি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। ওই রিটের ফলাফল কী হবে, তা এখনই বলা যাচ্ছে না।
প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী বিএনপি নয়াপল্টনের তাদের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সমাবেশ করার অনুমতি চেয়ে ডিএমপি বরাবর আবেদন করেছে। আগে-পরে ডিএমপি নয়াপল্টনে বিএনপিকে সভা করার অনুমতি দিলেও এবার গড়িমসি করছে। গত ১৮ নভেম্বর সমকালের এক প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, নয়াপল্টন ছাড়াও সমাবেশের জন্য বিএনপি আরও তিনটি বিকল্প ভেবে রেখেছে। যদি সরকার নয়াপল্টনে অনুমতি না দেয়, তাহলে মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান কিংবা আরামবাগ মোড়ে সমাবেশের অনুমতি চাইবে। তবে এসব স্থানে সমাবেশ করতে সরকার অনুমতি দেবে কিনা, তা নিয়ে সংশয় রয়েছে অনেকেরই। অন্যদিকে বিএনপিও এ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে যাবে না।
এদিকে ঢাকার সমাবেশ প্রশ্নে সরকারের কঠোর মনোভাব বুঝতে পেরে বিএনপি তাদের কথার সুর পরিবর্তন করেছে। এতদিন বিএনপি নেতারা ১০ ডিসেম্বর থেকেই সরকার পতনের চূড়ান্ত আন্দোলন শুরু হবে বলে হুঙ্কার দিলেও সম্প্রতি দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নমনীয় সুরে কথা বলেছেন। গত ১৭ নভেম্বর বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেছেন- '১০ ডিসেম্বর বিএনপির চূড়ান্ত আন্দোলন নয়। আমরা আশ্বস্ত করতে চাই, ১০ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগীয় সমাবেশে নতুন কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। তবে এমন কোনো কর্মসূচি ঘোষণা করব না, যাতে জনগণের দুর্ভোগ ও কষ্ট হবে।'
বিএনপি মহাসচিবের এমন বক্তব্যের পর কিছু প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। প্রথমত, তিনি কাদের আশ্বস্ত করতে চেয়েছেন? জনগণকে নাকি সরকারকে- সে কথা তিনি স্পষ্ট করেননি। তবে রাজনীতি সচেতন ব্যক্তিদের এটি ব্যাখ্যা করে বলার প্রয়োজন পড়ে না বিএনপি মহাসচিব কাদের আশ্বস্ত করার চেষ্ট করেছেন। তাঁর এ নমনীয় সুরে কথা বলা দলটির একটি গ্রুপ পছন্দ করছে না। তারা মনে করছে, এতে বিএনপির দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তবে রাজনৈতিক বোদ্ধারা মনে করেন, দলের নির্বাহী প্রধানের পদে থাকা মির্জা আলমগীর সঠিক পন্থাই অবলম্বন করছেন। এ মুহূর্তে সরকারের সঙ্গে সরাসরি সংঘাতে গেলে আন্দোলন অঙ্কুরেই বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকার যদি আবার কঠোর অবস্থানে চলে যায়, তাহলে তাদের কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে শেষ করা সম্ভব নাও হতে পারে।
এদিকে বিএনপির চলমান আন্দোলন কর্মসূচির পরিপ্রেক্ষিতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে হুঙ্কার-হুঁশিয়ারি অব্যাহত আছে। গত ২০ নভেম্বর ঢাকার উত্তরায় এক জনসভায় দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে 'স্বাধীনতার শত্রু' আখ্যায়িত করে ডিসেম্বরে তাদের বিরুদ্ধে রাজপথে খেলা হবে বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। ক্রুদ্ধ দুই পক্ষ রাজপথে নামলে পরিবেশ যে আর শান্ত থাকবে না তা না বললেও চলে। তেমনটি ঘটলে দেশের রাজনীতিতে সংঘাত-সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে; যা কারোরই কাম্য হতে পারে না।
মহিউদ্দিন খান মোহন: সাংবাদিক ও রাজনীতি বিশ্নেষক
মন্তব্য করুন