
গত ২৬ নভেম্বর ২০২২-এ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবদের বৈঠকের বিষয় নিয়ে এক ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, সম্প্রতি জঙ্গিরা দেশে যে মাথাচাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে বৈঠকে বলা হয়েছে। তিনি আরও বলেন, কারণ পার্বত্য চট্টগ্রামে আপনারা দেখেছেন, একটি দলকে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। (প্রথম আলো, ২৭ নভেম্বর ২০২২)।
সাম্প্রতিক সময়ে বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনার আলোকপাত করে প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনার মাত্রা ও গুরুত্ব এই লেখার মাধ্যমে তুলে ধরব।
ঘটনা- এক
গত অক্টোবরে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের খবর থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে নতুন একটি জঙ্গি সংগঠন 'জামায়াতুল আনসার ছিল হিন্দাল শারক্কিয়া' গঠনে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। নিরাপত্তা বাহিনীর বরাত দিয়ে সংবাদমাধ্যমগুলো জানায়, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সরকারের জিরো টলারেন্স নীতির কারণে যখন বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠন নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছিল তখন হরকাতুল জিহাদ, জামা'আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি), আনসার আল ইসলামের কিছু সদস্য মিলে ২০১৭ সালে নতুন করে এই উগ্রবাদী সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করতে থাকে।
এই সংগঠনটি মূলত তরুণদের দলের সদস্য হিসেবে সংগ্রহ করে এবং জিহাদের কথা বলে চরাঞ্চলে ও সীমান্তবর্তী পাহাড়ে প্রশিক্ষণ দিচ্ছিল। একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন 'কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট' (কেএনএফ) টাকার বিনিময়ে ওই উগ্রবাদী সংগঠনের সদস্যদের রাঙামাটি ও বান্দরবানের সীমান্তসংলগ্ন পাহাড়ে আশ্রয় ও প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছিল। উল্লেখ্য যে, কেএনএফ একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন এবং তাদের কার্যক্রমে মিয়ানমার ও উত্তর-পূর্ব ভারতে পরিচালিত হয়।
হিজরতের নামে তরুণদের জঙ্গিবাদে আকৃষ্ট করা নতুন একটি জঙ্গিগোষ্ঠী তৈরি, আবার একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপের সঙ্গে আপস করে বাংলাদেশের পাহাড়ি জনপদে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম, এক ধরনের অশনিসংকেত দেয় এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিবের ভাষায় স্পষ্ট যে, তখনও সবাইকে আটক করা সম্ভব হয়নি। তাই আশঙ্কা রয়েই যায়।
ঘটনা- দুই
গত জুন মাসে আন্তর্জাতিক ও দেশীয় গণমাধ্যমের মাধ্যমে আমরা জানতে পারি যে, পার্বত্য চট্টগ্রামে হানাহানি বন্ধে ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট (ইউপিডিএফ) নামক একটি গ্রুপ মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে সরকারকে একটি লিখিত প্রস্তাবনামা দেয়। অবশ্য সরকারের পক্ষ থেকে এরকম প্রস্তাব প্রাপ্তি বা আনুষঙ্গিক বিষয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেওয়া হয়নি।
এটি অনস্বীকার্য যে, যুগের পর যুগ ধরে পাহাড়ে চলা সংঘাত বন্ধে ১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের সঙ্গে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এএসএস) চুক্তির একটি যুগান্তকারী অর্জন। এই চুক্তিকে 'শান্তিচুক্তি' হিসেবে আখ্যায়িত করে পাহাড়ে শান্তির পরিবেশ তৈরি হবে বলে সংশ্নিষ্ট সকল মহলের আশা ছিল। এটি নির্দি্বধায় বাল যায়, এই চুক্তির মাধ্যমে পাহাড়ে শান্তি অনেকাংশে অর্জিত হয়েছে। তারপরও চুক্তি ও চুক্তি বাস্তবায়নে ধীরগতিকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সংগঠন ভেঙে গেছে। আমরা এখন দেখতে পাই যে, চুক্তি স্বাক্ষরকারী গ্রুপ জেএসএস দুই গ্রুপে বিভক্ত, আবার তৎকালীন শান্তিচুক্তিবিরোধী গ্রুপ ইউপিডিএফও আলাদা নেতৃত্বের দ্বারা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে গেছে (একটি ইউপিডিএফ ও অন্যটি ইউপিডিএফ-সংস্কারপন্থি)।
এই চারটি গ্রুপ নিজেদের মধ্যে বিগত বছরগুলোতে বিভিন্ন ধরনের সংঘর্ষে লিপ্ত আছে। পাহাড়ে বিভিন্ন ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য (যেমন- হত্যা, অপহরণ, চাঁদাবাজি) এই গ্রুপগুলো একে অন্যকে দায়ী করে আসছে।
এখন আসি ইউপিডিএফের দেওয়া প্রস্তাবনামার বিষয়ে। প্রস্তাবের বিষয়ে জানা যায়, ৬৬ পৃষ্ঠার প্রস্তাবটিতে ৮ ভাগে মোট ৮৭টি দাবি জানানো হয়। একটি ঐতিহাসিক চুক্তি হবার ২৫ বছর পর তৎকালীন চুক্তিবিরোধী গ্রুপ কর্তৃক এমন একটি প্রস্তাবনামা নিয়ে গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। পাহাড়ে একটি গ্রুপের সঙ্গে অন্য গ্রুপের দ্বন্দ্ব, দীর্ঘদিনের অবিশ্বাস ও আস্থার অভাবের কারণে নতুন এই কার্যক্রম (শান্তি প্রস্তাব) বাধাগ্রস্ত হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়।
ঘটনা- তিন
২০১৭ সালে প্রায় সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা জীবন বাঁচানোর জন্য মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। ১৯৭৮ সাল থেকে বিভিন্ন সময় জীবন বাঁচানোর তাগিদে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী বাংলাদেশে এসেছে। বর্তমানে সরকারি হিসাবমতে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে বসবাস করছে। এই জনগোষ্ঠীর মধ্যে কিছু কিছু গ্রুপ এসেছে, যারা নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। তাছাড়া তারা হত্যা, অপহরণ, মাদক ও চোরাচালান, চাঁদাবাজির মতো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। এসব গ্রুপ ক্যাম্পের ভেতরে, আবার বাইরে (কক্সবাজার ও বান্দরবানসংলগ্ন পাহাড়ে বা মাঝে মাঝে মিয়ানমার ও বাংলাদেশের মধ্যে ঘড় গধহং খধহফ (নো ম্যানস ল্যান্ড) অবস্থান করে বলে অনেক সংবাদমাধ্যম থেকে জানা যায়। বাস্তুচুক্তি ও শরণার্থীবিষয়ক লিটারেচার বিশ্নেষণ করলে জানা যায় যে, যখন অনেক সংখ্যক লোক জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত হয়ে অন্য একটি দেশে আসে তখন তাদের মধ্যে জঙ্গি গ্রুপ, উগ্রবাদী বা বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপ ও অজ্ঞাতভাবে যারা আশ্রয়দানকারী দেশে বিভিন্ন ধরনের সন্ত্রাস বা জঙ্গিবাদী কার্যক্রম ঘটায়। তারা প্রয়োজনে আন্তঃরাষ্ট্রীয় অপরাধ ও উগ্রবাদী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ সরকার তার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের এসব গ্রুপকে কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন ও আইনের আওতায় আনছে। তারপরও ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা দেখে মনে হয় বিষয়টি নিয়ে অবহেলার সুযোগ নেই।
এই ঘটনাগুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার তথা বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী অঞ্চলের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ যে কোনো সময় দেশীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠী ও আঞ্চলিক বিচ্ছিন্নতাবাদী গ্রুপগুলো বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করতে পারে এবং তারা আঞ্চলিক অস্থিতিশীলতাও তৈরি করতে পারে।
তাছাড়া দেশীয় ও আঞ্চলিক বা আন্তর্জাতিক উগ্রবাদী অথবা জঙ্গি সংগঠনগুলো কোনোভাবেই যাতে নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন, সুবিধা প্রতিস্থাপন বা কার্যক্রম পরিচালনা করতে না পারে সে ব্যাপারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তাদের দেশে পাঠানোর প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার পাশাপাশি একটি টেকসই রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পলিসি বা ম্যানুয়াল তৈরি করা এখন খুবই প্রয়োজন। এটি একটি সমন্বিত পদ্ধতি হবে, যার আলোকে রোহিঙ্গা শরণার্থী ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে।
সর্বোপরি বাংলাদেশের কথা চিন্তা করে সমাজের সকল স্তরের লোকদের বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামবাসীদের সোচ্চার হতে হবে। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। আবার আসি মন্ত্রিপরিষদ সচিবের কথায়। তিনি এই ব্রিফিংয়ে আরও বলেন, জঙ্গিরা যাতে কোনোভাবে কোথাও আশ্রয় নিতে না পারে, সে ব্যাপারে সবাইকে দৃষ্টি রাখার জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর এই নির্দেশনা অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ, বাস্তবিক এবং প্রাসঙ্গিক।
মন্তব্য করুন