- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- নেপালের নির্বাচন এবং দক্ষিণ এশীয় হিসাব-নিকাশ
প্রতিবেশী
নেপালের নির্বাচন এবং দক্ষিণ এশীয় হিসাব-নিকাশ

দক্ষিণ এশিয়ার দেশ নেপালে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ভোট অনুষ্ঠিত হলো ২০ নভেম্বর। নেপালের নির্বাচনটি সে দেশের জন্য তো বটেই, দক্ষিণ এশিয়ার জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। যদিও এবারের নির্বাচনে সেখানে কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। সে জন্য গত রোববার সরকার গঠনের জন্য সাত দিন সময় দেন নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী। নির্বাচন কমিশনের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রেসিডেন্ট নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছেন। একটি দল বা জোটের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য ২৭৫ সদস্যের হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভে ১৩৮টি আসন প্রয়োজন। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বাধীন দল নেপালি কংগ্রেস পার্টি সেখানে ৮৯টি আসন পেয়েছে এবং তাদের মিত্রদের ৪৭টি আসন মিলে ক্ষমতাসীন জোটের আসন সংখ্যা ১৩৬। দ্বিতীয় বৃহত্তম দল হিসেবে ৭৮টি আসন পেয়েছে নেপাল কমিউনিস্ট ইউনিফায়েড মার্ক্সিস্ট লেনিনিস্ট (ইউএমএল) পার্টি। তাদের মিত্র মিলে মোট আসন সংখ্যা ৯২। আর কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল মাওয়িস্ট সেন্টার সিপিএন-মাওয়িস্ট সেন্টার পেয়েছে ৩২ আসন। তবে শের বাহাদুর দেউবাই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে।
নেপালে কোনো দলের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন না করার মানে দেশটিতে বহুদলীয় ধারা ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। বলা প্রয়োজন, নেপালে ২০১৫ সালে সংবিধান কার্যকরের পর এবার দ্বিতীয় নির্বাচন। সেখানে একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠতা, অন্যদিকে ভোটের আনুপাতিক হার দু'ভাবেই নির্বাচন হয়। হাউস অব রিপ্রেজেন্টেটিভসের ২৭৫ আসনের মধ্যে ১৬৫ আসনে এফপিটিপি পদ্ধতিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন হয়। আর ১১০টি আসন প্রপরশনাল রিপ্রেজেন্টেশন (পিআর) পদ্ধতিতে আনুপাতিক হারে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আনুপাতিক পদ্ধতির মাধ্যমে ছোট দল ও বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা হয়। ব্যবস্থা হিসেবে এটি ভালো নিঃসন্দেহে। বিশেষ করে নেপালে যেখানে রাজতন্ত্র ছিল; রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের মাধ্যমে আন্দোলনে সেখানে ২০০৮ সালে পরিবর্তন আসে।
২৩৯ বছর রাজতন্ত্রে থাকা ৩ কোটি জনসংখ্যার দেশ নেপালে প্রতিবেশী ভারত ও চীন উভয় দেশের প্রভাব বিদ্যমান। ২০০৮ সাল থেকে নেপালে ১০টি সরকারের পরিবর্তন হয়েছে। নেপালে নির্বাচন ও সরকার নিয়ে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে স্বাভাবিকভাবেই ভারত ও চীনের বিশেষ আগ্রহ রয়েছে। বস্তুত নেপালের ভূরাজনৈতিক অবস্থান একে অনেকটা 'বাফার স্টেটে' রূপান্তর করেছে। দেশটি যেমন নানাদিক থেকে ভারতের ওপর নির্ভরশীল তেমনি সেখানে চীনের ভূমিকাও কম নয়। দেউবা সরকারের আগে মাওবাদীরা যখন নেপালে ক্ষমতায় ছিল তখন চীনের সঙ্গে দেশটির ঘনিষ্ঠতা বাড়ে। নেপালের অবকাঠামোগত উন্নয়নে চীন সহায়তা করে। তবে নেপালের স্বার্থেই উভয় দেশের সঙ্গে সদ্ভাব বজায় রাখতে হবে।
শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বাধীন দল নেপালি কংগ্রেস সরকার গঠন করলে ভারতের সঙ্গে দেশটির সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হতে পারে। যদিও ভারত ও চীন উভয়েই নেপালে প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করবে। নেপালকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক পরাশক্তিগুলো যেভাবে ভূমিকা রাখবে তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেরও চোখ থাকবে নিঃসন্দেহে। কিন্তু এবারের নির্বাচনটি নেপালের জন্য অনেকটা পরীক্ষার মতো। নেপাল ছোট দেশ হলেও দেশটির নির্বাচনে চূড়ান্ত ফল পেতে কিছুটা সময় লাগে। কারণ, এর ফল পাহাড়ি দুর্গম এলাকা থেকে রাজধানীতে পৌঁছতে সময় লাগে। এখানে জাতীয় নির্বাচনের সময় সাতটি প্রদেশেও নির্বাচন হয়। এবার কোনো দল বা জোট সহজে বিজয় পেলে সমীকরণ হয়তো সহজ হতো। সেটি না হওয়ায় সমীকরণ খুব কঠিন না হলেও বিলম্ব এবং অন্যান্য জটিলতাও চলে আসছে। শেষ পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট কর্তৃক সরকার গঠনের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
বৈশ্বিক সংকটের অংশ হিসেবে নেপালেও খাদ্য ও জ্বালানির সমস্যা রয়েছে। সেখানে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাও অতটা সচ্ছল নয়। দেশটিতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে রয়েছে। সেখানে কভিড-১৯ এর ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে মুদ্রাস্ম্ফীতি বেড়েছে। অবকাঠামো প্রকল্পে কম বিনিয়োগের কারণে নেপালে দীর্ঘ মেয়াদে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। নেপাল জ্বালানি তেলসহ প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় অর্থনৈতিক সংকট বাড়ছে। তারপরও দেশটি হয়তো সামলে নিতে চেষ্টা করছে। কিন্তু সংকট থেকে উত্তরণে নতুন সরকারের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। বিশেষ করে ভারত ও চীনের সঙ্গে কীভাবে সম্পর্ক রাখবে, সেটি গুরুত্বপূর্ণ। উভয় দেশের সঙ্গে কৌশলী হয়ে ভারসাম্য বজায় রাখতে পারলে নেপাল এগিয়ে যেতে পারে। ভারসাম্য বজায় রাখা চ্যালেঞ্জ হলেও নেপালের স্বার্থেই এটি দরকার। নতুন সরকার গঠনে হয়তো ভূরাজনৈতিক বিবেচনা সেখানে আমরা দেখব। বর্তমান মেরূকরণের বিশ্বে নেপালকে আরও সতর্ক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসেবে বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের ঐতিহাসিক সম্পর্ক রয়েছে। হিমালয়কন্যা নেপাল এমনিতেই শান্তিপ্রিয় দেশ। নেপালের সঙ্গে পর্যটনসহ অর্থনৈতিক নানা ক্ষেত্রে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক অনেক দৃঢ়। আমরা দেখেছি, গত বছরের মার্চ মাসে নেপালের প্রেসিডেন্ট বিদ্যা দেবী ভাণ্ডারী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসেছিলেন। এর আগে ২০১৯ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি মোঃ আবদুল হামিদ নেপাল সফর করেন। বস্তুত ১৯৭২ সালে নেপালের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপিত হওয়ার পর থেকেই দুই দেশের সম্পর্ক এগিয়ে চলেছে। গত বছর নেপালের সঙ্গে পর্যটন সহযোগিতা; স্যানিটারি ও ফাইটোস্যানিটারি সহযোগিতা জোরদার; সাংস্কৃতিক বিনিময় কর্মসূচি এবং রোহানপুর-সিগবাদ রেলওয়ে রুট সংস্কারবিষয়ক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশ থেকে অনেক পর্যটক যেমন নেপাল যায়, তেমনি নেপালের অনেক শিক্ষার্থী আমাদের মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে। নেপালে বাংলাদেশের ওষুধের ভালো বাজারও তৈরি হয়েছে। সেখানে সরকারে যারাই আসুক, আমাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার ক্ষেত্রে কোনো বাধা তৈরি হওয়ার কথা নয়।
বাংলাদেশের সঙ্গে নেপালের একটি উপ-আঞ্চলিক দিক রয়েছে। বিশেষ করে যোগাযোগ ও জ্বালানি বিষয়ে ভারতকে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশ-ভারত-নেপাল, অন্যদিকে বাংলাদেশ-ভারত-ভুটান-নেপাল উপ-আঞ্চলিক সহযোগতিার সুযোগ রয়েছে। এ ক্ষেত্রে এরই মধ্যে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ভূবেষ্টিত নেপাল বাংলাদেশের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরও সুদৃঢ় করার মাধ্যমে এগিয়ে যেতে পারে। ফলে নেপালের নতুন সরকারের আমলে বাংলাদেশ-নেপাল দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
লক্ষণীয়, নেপালের এবারের নির্বাচনে তরুণ নেতৃত্ব এগিয়ে এসেছে। রবি লামিচানের নেতৃত্বাধীন রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টি ২০টি আসন পেয়ে নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছে। সেখানে তরুণরা কোথাও কোথাও হেভিওয়েট প্রার্থীদেরও ধরাশায়ী করেছে। নেপালে গণতান্ত্রিক যাত্রা খুব বেশি দিনের না হলেও সেখানে ভোট সুষ্ঠু হওয়ার ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠেনি। একই সঙ্গে কোনো দলের একক আধিপত্য না হওয়ার বিষয়টিও ক্ষমতার ভারসাম্যের দিক থেকে ইতিবাচক। নেপালের অবস্থান বিবেচনায় দেশটি আঞ্চলিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ এবং সেদিক থেকেই আঞ্চলিক শক্তিগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে। ভারত ও চীনের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে পারলে নেপাল অর্থনেতিক সংকট মোকাবিলায় এগিয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা থেকে সেদিক থেকে শের বাহাদুর দেউবা এগিয়ে থাকবেন বলে আমার বিশ্বাস।
ড. দেলোয়ার হোসেন: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন