- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মার্কিন দায়
আন্তর্জাতিক
আফগানিস্তানে তালেবান শাসনের মার্কিন দায়

সোভিয়েত ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক বলয়ের অগ্রযাত্রা ঠেকাতে মার্কিনরা দেশে দেশে মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরও 'কমিউনিজমের ভূত' তাড়াতে সেইসব প্রকল্পে তারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার ঢেলেছে। সেই পথ ধরে আফগানিস্তানে এসেছিল তালেবান সরকার। কিন্তু মার্কিন বলয়ও শেষ পর্যন্ত আফগানিস্তানে টিকতে পারেনি।
যুক্তরাষ্ট্র প্রযোজিত এই তালেবান পুনরায় ক্ষমতায় এসে নারীদের লেখাপড়া ও ঘরের বাইরে যাওয়া নিষিদ্ধ করেছে। তাঁদের জন্য জিম-পার্ক, সিনেমা-থিয়েটার নিষিদ্ধ। একা চলাফেরা, কাজকর্মও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেখানে নারীদের স্বামীর সেবা, সন্তান উৎপাদন, লালন-পালন ও ঘরের কাজই শেষ কথা। খাবারের জন্য কন্যাশিশুদের বয়স্ক পুরুষের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ছেলেদের দাড়ি রাখা বাধ্যতামূলক এবং পাশ্চাত্য ধাঁচের পোশাক পরিধান নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এক কথায়- সেখানে তালেবানের কথাই আইন। তাদের কথার বাইরে গেলে দোররা, পাথর ছুড়ে মারা, হাত কাটা, মাটিতে পুঁতে রাখা, মৃত্যুদণ্ডসহ মধ্যযুগীয় কঠোর শাস্তির বিধান করা হয়েছে। এক কথায়- মোল্লাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে আক্ষরিক অর্থে দেশটিতে মধ্যযুগীয় শাসন চালানো হচ্ছে।
আফগানিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ করতে গিয়ে অনেকে এখনও সোভিয়েত ইউনিয়নের সমালোচনা করেন। ইতিহাস পর্যালোচনার ক্ষেত্রে সে আলোচনা নিশ্চয় গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু আফগানিস্তানের পশ্চাৎপদ সমাজে আধুনিকতার ছোঁয়া সমাজতন্ত্রীরাই এনে দিয়েছিল। নারী-পুরুষ সমতা ও উন্নত জীবনের স্বপ্ন-বাস্তবতা তৈরি করেছিল। গোত্র শাসন ও শাসনতন্ত্র ভেঙে দিয়েছিল। ধর্মভিত্তিক, গোত্রভিত্তিক শিক্ষার বিপরীতে আধুনিক শিক্ষার প্রচলন করেছিল। যেখানে ছেলে-মেয়ে, ধনী-দরিদ্র সবাই পড়তে পারত। স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত তৈরি করেছিল। মেয়েরা খেলাধুলা, নাটক-থিয়েটার করতে পারত। শিক্ষার্থীরা রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে বৃত্তি নিয়ে পড়তে যেত। বিদেশি শিক্ষক-প্রশিক্ষকরা গিয়ে তাদের আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানের উন্নত শিক্ষা দিয়েছিলেন। তারা গম-খাদ্য, সার, তেল-গ্যাস-রেশনসহ অন্যান্য পণ্যসেবা পেত। ঘোড়া-গাধার গাড়ির বদলে উন্নত মোটরযান পেয়েছিল।
তখন থেকে আফগানিস্তানের মেয়েরা অধিকার-মর্যাদা পেয়েছিলেন। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তেন। তাঁদের পোশাকের স্বাধীনতা ছিল। নিজেদের উন্নত জীবন গড়ে তোলার সুযোগ ছিল। পেশা নির্বাচনের স্বাধীনতা ছিল। তাঁরা বিচারক, সচিব, এমপি, মন্ত্রী, উদ্যোক্তা- সবই হতে পারতেন। রাষ্ট্র ও সরকারের নীতিনির্ধারণীতে ছিলেন। আজকের তালেবান সরকারের কাঠামোয় নারীর কোনো অবস্থান বা অস্তিত্ব নেই।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে আবার মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তি আফগানিস্তানে নারী অধিকার, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নেই বলে মায়াকান্না করছে। তাদের বিরুদ্ধে জঙ্গিবাদ-মৌলবাদ-সন্ত্রাসবাদের অভিযোগ করা হচ্ছে। তারা কি তাহলে তালেবান তৈরি করেছিল সেখানে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য? এ এক নিদারুণ স্ববিরোধিতা।
আশির দশকে তালেবানসহ উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠনগুলোর মাধ্যমে আমেরিকা প্রতিনিয়ত প্রচার করত- সোভিয়েত রাশিয়া ও সমাজতন্ত্রীরা হচ্ছে ইসলাম ও মানবতার শত্রু। এ কথা বলে আফগানিস্তানের প্রগতিশীল শাসকের বিরুদ্ধে তালেবানকে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ১৯৮৯ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য প্রত্যাহারের পর তালেবান ক্ষমতা দখল করে। নাইন ইলেভেনে যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ারে আল কায়দা হামলার পর আফগানিস্তানে জঙ্গি আশ্রয়ের অজুহাতে সেখানে মার্কিন হামলা এবং সামরিক ঘাঁটি স্থাপিত হয়।
আফগানিস্তানে সোভিয়েত সৈন্যদের উপস্থিতি যেমন সমর্থন করি না, তেমনি মার্কিন সামরিক ঘাঁটিরও বিরোধিতা করি। কিন্তু মার্কিন শাসকের দ্বিমুখী নীতির ফলে একটি দেশের সমাজ-রাজনীতির কতটা অধঃপতন ঘটল, তা বিশ্ব আজ প্রত্যক্ষ করছে। আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে আফগানিস্তানের উজ্জ্বল অতীতের যে ছবি-ভিডিও প্রদর্শন করা হয়, তা সোভিয়েত জমানার চিত্র।
বিশ্বব্যাপী মৌলবাদ, ধর্মভিত্তিক ও জঙ্গিবাদী রাজনীতির মদদদাতা কে? পাশ্চাত্য থেকেই প্রকাশিত নানা গ্রন্থ, তথ্যচিত্র ও নথিপত্রে এর প্রমাণ আছে। এমনকি তৎকালীন পশ্চিমা শাসক অনেকেই প্রকাশ্যে বক্তব্যে এ বিষয়ে তাঁদের গ্লানি ও অপরাধের কথা স্বীকার করেছেন। হিলারি ক্লিনটন নিজের স্মৃতিকথা হার্ড চয়েসেসে লিখেছেন, ইরাকে মার্কিন অভিযানে সমর্থন দেওয়া ভুল ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে তিনি সেই 'ভুল' নিয়ে দুঃখ প্রকাশও করেছেন।
সোভিয়েত ইউনিয়নের বিপর্যয়ের পর মার্কিন বলয়ের কাছে মৌলবাদের প্রয়োজনীয়তা কমে যায়। কিন্তু এর মধ্যে মৌলবাদ তাদের দাঁত-নখ শক্ত করে ফেলেছে। যে তালেবানের তারা জন্ম দিয়েছিল, তাদের সঙ্গেই টানা ২০ বছর আফগানিস্তানে যুদ্ধ করতে হয়েছে। এতে মার্কিন ও পশ্চিমা শক্তির প্রায় পাঁচ হাজার সৈন্য নিহত ও ২০ হাজার আহত হয়েছে। এক ট্রিলিয়নের বেশি ডলার খরচ হয়েছে। আফগান সৈন্য ও নাগরিক নিহত হয়েছে এর কয়েক গুণ। সেখানে পরাজিত হয়ে ২০২১ সালে তাদের মাথা নত করে চলে যেতে হয়েছে।
যে কোনো দেশের অধিকার আছে তাদের শাসক ও শাসন পদ্ধতি পছন্দের। কিন্তু তার প্রক্রিয়া কী? তালেবান সশস্ত্র সংঘাতের মাধ্যমে ক্ষমতায় এলেও তারা যে ধারার শাসন প্রতিষ্ঠা করেছে, তার পক্ষে কি সব মানুষের সমর্থন আছে? সে বিষয়ে কি জনগণের ম্যান্ডেট নেওয়া হয়েছে? হয়নি। তারা অস্ত্রের শক্তিকেই যে কোনো কিছু করার অধিকার মনে করছে। সেটি সমর্থনযোগ্য নয়। সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে নেপালে মাওবাদীরা ক্ষমতা দখল করলে তারাও জনগণের ম্যান্ডেট নিয়েছে।
সময়ের প্রয়োজনে কট্টর ইসলামী প্রজাতন্ত্র সৌদি আরবের তরুণ শাসক মোহাম্মাদ বিন সালমান তাঁর দেশকে ধর্মান্ধতা ও রক্ষণশীলতা থেকে বের করে আনতে বিভিন্ন সংস্কার করছেন। নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া, ছবি দেখা, একাকী চলার স্বাধীনতা দেওয়া, চুল ছোট করতে পারা, পার্টি-ফাংশন-কনসার্ট করা, পাসপোর্ট করা, সিনেমা হল উন্মুক্ত করাসহ নানা অধিকার দিয়েছেন। বিদেশি পর্যটক আকর্ষণ করতে নানা কর্মসূচি নিয়েছেন।
সৌদি আরবের মতো কট্টর ইসলামী দেশ যখন সংস্কার-পরিবর্তনের দিকে হাঁটছে; ইরানে যখন সংস্কারের পক্ষে অভাবনীয় সংগ্রাম চলছে; তখন আফগানিস্তান আরও অন্ধকারে প্রবেশ করছে। তবে বাংলাদেশের মতো দেশে ধর্মান্ধতা ও মৌলবাদের বিপদ না কমে বরং বেড়েছে। আশির দশকে অনেক বাংলাদেশি মুজাহিদ আফগানিস্তানে তৎকালীন সোভিয়েত সৈন্যদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গিয়েছিল। তারা দেশে একটি কট্টর ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার 'স্বপ্ন' নিয়ে ফিরে এসেছে। কতসংখ্যক বাংলাদেশি সে যুদ্ধ করেছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান অবশ্য নেই। এদিকে কওমিভিত্তিক হেফাজতে ইসলামের বক্তব্যে এটা স্পষ্ট- তারা এখনও তালেবান স্টাইলের শাসন ব্যবস্থা চায়। এ প্রশ্নে রাজনৈতিক কৌশল ও নির্লিপ্ততা আফগানিস্তানের মতোই আত্মঘাতী হতে পারে।
ড. মঞ্জুরে খোদা :লেখক-গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্নেষক; ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়, কানাডা
মন্তব্য করুন