খ্রিষ্টীয় নববর্ষের প্রথম দিন পেরোতে না পোরোতেই গভীর রাতে বান্দরবানের লামা উপজেলার সরই ইউনিয়নের রেংয়েন ম্রোপাড়ার ম্রো বসতি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই সঙ্গে চালানো হয় লুণ্ঠন ও ব্যাপক ভাঙচুর; লন্ডভন্ড করা হয় ঘরবাড়ি। লামার রেংয়েন ম্রোপাড়ার বাসিন্দাদের জন্য ২০২৩ সাল বিরাট ক্ষত নিয়েই শুরু হলো।

মধ্যরাতে ঘুমন্ত মানুষের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, তাণ্ডব চালানো- এসবই পূর্বপরিকল্পিত; সন্দেহ নেই। গ্রামপ্রধান রেংয়েন কারবারী বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, হামলাকারীরা আনুমানিক রাত ১টায় ট্রাকে করে গ্রামে আসে। তারা ঘরবাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়; ভাঙচুর ও লুটপাট শুরু করে। পাড়াবাসী জান বাঁচাতে কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। রেংয়েন কারবারী আরও জানান, লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের সন্ত্রাসীরাই এ হামলা চালিয়েছে।

এবারই প্রথম নয়; লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের লোকজন এর আগেও একাধিকবার এই এলাকায় সন্ত্রাসী হামলা চালিয়েছে। রেংয়েন ম্রোপাড়া, জয়চন্দ্র ত্রিপুরাপাড়া ও লাংকম ম্রোপাড়া- এই তিনটি জুমিয়াপাড়া পাশাপাশি অবস্থিত। গত বছর ২৬ এপ্রিল তিনটি পাড়ার জুম ভূমি, বাগান ও প্রাকৃতিক বন পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সেই আগুনে ৪০০ একর এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বন্যপ্রাণী, প্রাকৃতিক বন, পাড়াবাসীর জুম ফসল, বাগান-বাগিচা সবকিছু পুড়ে যায়। প্রাণ-প্রতিবেশের বিপর্যয়সহ এলাকায় ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা দেয়। গত বছর ১৩ জুলাই সরই ইউনিয়নের ভূমি রক্ষা আন্দোলনের সংগঠক রংধজন ত্রিপুরাকে এক দল সন্ত্রাসী হামলা করে। মাথায় জখম নিয়ে তিনি অনেক দিন চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এর পর ৬ সেপ্টেম্বর রেংয়েন ম্রোপাড়ার একমাত্র পানির উৎস পাহাড়ি ঝিরিতে বিষ ছিটিয়ে দেওয়া হয়। এতে কাঁকড়া, চিংড়ি, বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ মরে ভেসে উঠতে থাকে। মরা প্রাণীর পচনে পানিদূষণ বেড়ে যায়। সাত দিনের বেশি সময় পাড়ার লোকজন ঝিরির পানি ব্যবহার করতে পারেনি। ২৪ সেপ্টেম্বর রেংয়েনপাড়ার এক জুমচাষির তিন শতাধিক কলাগাছের চারা কেটে দেওয়া হয়। সব হামলাই চালানো হয়েছিল প্রকাশ্য দিবালোকে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি, ২০২৩ সালের হামলার চিত্র একটু ভিন্ন। আগে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু ছিল জুম ভূমি, প্রাকৃতিক বন, পানির উৎস, কলাবাগান এবং আন্দোলনের সংগঠক। কিন্তু এবার মধ্যরাতের হামলার লক্ষ্য সরাসরি বসতভিটা। হামলা শুধু নয়; অগ্নিকাণ্ড, লুটপাট ও ভাঙচুর। স্পষ্টতই সন্ত্রাসের ব্যাপকতা বেড়েছে। যাদের বিরুদ্ধে এই সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালানো এবং অগ্নিসংযোগের অভিযোগ, সেই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কর্তৃপক্ষ খুবই প্রতাপশালী, তাতে সন্দেহ নেই। দুর্দান্ত প্রতাপ ও দাপট দেখিয়ে তারা নিত্যনতুন কায়দায় অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ কী? হামলাকারীদের পরিচয় কী? জানা গেছে, ১৯৯২-৯৩ সালের দিকে লামার সরই এলাকায় রাবার বাগান সৃজনের জন্য বেশ কয়েকজন ব্যক্তিকে জুম ভূমি ও ছোট ছোট টিলা ইজারা দেয় সরকার। ইজারা পাওয়া অর্ধশতাধিক ব্যক্তি একত্র হয়ে 'লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ' গঠন করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন অবসরপ্রাপ্ত সামরিক-বেসামরিক পদস্থ আমলা; যাঁরা এক সময় বান্দরবান পার্বত্য জেলায় বিভিন্ন প্রশাসনিক দায়িত্বে ছিলেন। তালিকায় তাঁদের আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন। পাহাড়ে ভূমি ব্যবস্থাপনার যে প্রথাগত আইন, সেই নিয়মনীতিকে তোয়াক্কা না করেই দেওয়া ইজারার শুরু থেকেই ইজারাপ্রাপ্ত এলাকার বাইরে গিয়ে ভূমি জবরদখল শুরু করেন। অন্যদিকে প্রান্তিক জুম্ম জনগণ মালিকানা হারাতে থাকে। নিজ ভূমি ও বসত থেকে ক্ষেত্রবিশেষে উচ্ছেদ হয়ে যায়। সাম্প্রতিক হামলা, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর তারই ধারাবাহিকতা মাত্র।

ম্রোপাড়ায় সর্বশেষ হামলায় মানবিক বিপর্যয়ও যে ভয়াবহ- সংবাদমাধ্যমে উঠে আসা চিত্রেই তা স্পষ্ট। পাহাড়ের তীব্র শীতে ঘরপোড়া লোকজন মুক্ত অঙ্গনে পড়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। ঠান্ডা থেকে পরিত্রাণ পেতে রাতভর আগুন পোহানোর ছবিও দেখা যাচ্ছে। আক্রান্ত পরিবারগুলোর শিশু ও বয়স্কদের অবস্থা নিশ্চয় আরও করুণ। স্বাভাবিক জীবনচক্রেও পাহাড়ের অভাবী মানুষদের শীত নিবারণ করা কঠিন। আর খোলা জায়গায় শীতের তীব্রতা অনুমান করতে গেলেই গা শিউরে ওঠে।

উদ্বেগ ও বেদনার বিষয়, ঘটনার তিন দিন অতিবাহিত হলেও প্রশাসনের কোনো সহায়তা ম্রোপাড়ায় পেঁৗঁছেনি। আগুনে সহায়-সম্বল হারানো পরিবারগুলোয় খাদ্যাভাবও চলছে। পাড়াপড়শির সহায়তায় কোনোমতে দু'মুঠো ভাত জোগাড় হচ্ছে। কিন্তু সেই পড়শিরা তো নিজেরাই অভাবী ও দিনমজুর। আরও উদ্বেগের বিষয়, এই ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা যারা চালিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে এখনও মামলা হয়নি; গ্রেপ্তার তো পরের ব্যাপার। মূলত এ কারণেই লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজ দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে।

জাতীয় মানবাধিকার কমিশন ২০২২ সালের ২৬ এপ্রিলের ঘটনার পর বান্দরবান জেলা প্রশাসন, পুলিশ এবং পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়কে কিছু নির্দেশনা দিয়েছিল। লামার সরই ইউনিয়নের তিন জুমিয়া গ্রামবাসীকে সুরক্ষা দেওয়ার সেই নির্দেশনা বারবার লঙ্ঘিত হয়েছে। বরং উল্টো চিত্রই দৃশ্যমান- স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসনের সঙ্গে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের দহরম-মহরম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় দায়িত্বপ্রাপ্তদের এমন কার্যকলাপ যে অপরাধী চক্রকেই উৎসাহিত করে- তার প্রমাণ লামার সরই ইউনিয়নে বারবার দেখা যাচ্ছে।
২৬ এপ্রিলের ঘটনার পরপরই বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদ একটি তদন্ত দল পাঠায়। জেলা পরিষদের সেই তদন্ত প্রতিবেদনে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের বিরুদ্ধে সরকার প্রদত্ত ইজারার শর্তাবলি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনা হয়। কিন্তু কী এক অদৃশ্য কারণে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ইজারা এখনও বহাল তবিয়তে।

পার্বত্য শান্তিচুক্তি অনুযায়ী যে আইন বলবৎ করা হয়েছে, তাতে লামা রাবার ইন্ডাস্ট্রিজের ইজারা কার্যত অবৈধ। কিন্তু খোদ পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তির সিংহভাগ যেহেতু ২৫ বছর পরও অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে; বাতিলযোগ্য ইজারাটি এখনও বাতিল হয়নি। আমাদের প্রত্যাশা, সরকার অচিরেই লামা রাবার কোম্পানির অবৈধ ইজারা বাতিল করবে। আর রেংয়েন ম্রোপাড়ায় সংঘটিত হামলা ও অগ্নিসংযোগকারী সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে। আক্রান্ত ও ভুক্তভোগী জুমিয়া পরিবারগুলো অনাহারে মুক্ত অঙ্গনে শীতার্ত দিনরাত পার করছে- এই অমানবিক দৃশ্যের অবসান হোক অগ্রাধিকার ভিত্তিতে।

দীপায়ন খীসা: তথ্য ও প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম