আওয়ামী লীগ যদিও ২০১৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নীতি গ্রহণের অঙ্গীকার করেছিল, পরবর্তী চার বছরে সেটা 'বাত্‌ কা বাত' হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের স্মরণে আছে যে ২০০১ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতি গবেষণা সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের বিশ্ব সূচকে বাংলাদেশ সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করেছিল। ওই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রথম বছর ক্ষমতাসীন ছিল আওয়ামী লীগ, পরের চার বছর ক্ষমতাসীন ছিল বিএনপি-জামায়াত জোট। এরপর সামরিক বাহিনী-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দু'বছরের শাসনামলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রচণ্ড দমননীতি বাস্তবায়নের কারণে বাংলাদেশ ওই 'ন্যক্কারজনক চ্যাম্পিয়নশিপ' থেকে নিস্কৃতি পেয়েছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় এলে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনই 'নখদন্তহীন' হয়ে পড়ে। ২০১৪ সাল থেকে গত আট বছর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আফগানিস্তানের পর সবচেয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তকমা অর্জন করে চলেছে।

প্রশ্ন হচ্ছে, দুর্নীতির অর্থ যাচ্ছে কোথায়? গত বছর সেপ্টেম্বরে সিআইডির বরাতে পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছিল, শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। এর অর্থ, বৈদেশিক আয়ের ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশে প্রবেশ করছে না। বিদেশ থেকেই পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রা হিসেবে জমা হয়ে যাচ্ছে।

হুন্ডির সঙ্গে যদি আমরা আমদানির ওভারইনভয়েসিং, রপ্তানির আন্ডারইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় দেশে ফেরত না আনার বিষয়গুলো যোগ করি, তাহলে দেখা যাবে বর্তমানে বছরে অন্তত দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। ফলে ২০২১ সালের আগস্টের ৪৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ২০২৩ সালের জানুয়ারিতে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুসারে ২৪ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। অবশ্য সরকারের ঘোষণামতে, এই রিজার্ভ ৩২ দশমিক ৫২ বিলিয়ন ডলার। রিজার্ভে এমন পতনের ধারা যে কোনো বিবেচনাতেই অত্যন্ত বিপজ্জনক।

বস্তুত দেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে, সেটার জন্য দায়ী প্রধানত পুঁজি পাচার। দেশের অর্থ পাচার করে দুর্নীতিগ্রস্তরা ঘরবাড়ি-ব্যবসাপাতি কেনার হিড়িক ফেলেছে। সরকারকে মেনে নিতেই হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। আমাদের বর্তমান সরকারকে অনেকে 'ব্যবসায়ীদের সরকার' আখ্যায়িত করেন। বর্তমান সংসদের ৬২.৭ শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অতএব, সরকারে আসীন অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-নেতাকর্মী পুঁজি পাচারকারী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। সমস্যার সত্যিকার সমাধান চাইলে প্রথমে সরকারকে আন্তরিকভাবে সমস্যাটি স্বীকার করে নিতে হবে।


দুর্ভাগ্যক্রমে দেখা যাচ্ছে, বিষয়টি নিয়ে স্বয়ং অর্থমন্ত্রী সিরিয়াস নন। চলতি অর্থবছরের বাজেটে মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ কর দিয়ে পাচার করা অর্থ বিনা প্রশ্নে দেশে ফেরত আনার 'সুযোগ' ঘোষণা করা হয়েছিল। খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে, কেউ এই সুবিধা গ্রহণ করেনি। আমি তখনই বলেছিলাম, এ ধরনের 'টোটকা দাওয়াই' প্রকৃত অর্থে জনগণের সঙ্গে 'মশকরা' ছাড়া আর কিছু নয়। এর মধ্য দিয়ে পুঁজি পাচারের পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করে ফেলা হয়েছে। গত ৭ জানুয়ারি অর্থমন্ত্রী বলেছেন- কেউ এই সুবিধা গ্রহণ না করলে সরকারের কিছুই করার নেই। বাজেট বানানোর সময় তিনি নাকি এই খাত থেকে কোনো অর্থ আসবে বলে হিসাবেও ধরেননি। দায় অস্বীকার করার কী অভিনব প্রয়াস!

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ইতালিতে আটটি তদন্ত টিম প্রেরণ কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার পরামর্শ কিছুদিন আগে দিয়েছিলাম আমি। সে ব্যাপারে কোনো সাড়াশব্দ নেই! এমনকি রপ্তানি আয় রপ্তানিকারকদের নিজের কাছে রেখে দেওয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা এবং একই সঙ্গে কত দিনের মধ্যে রপ্তানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে, সে সময়সীমাকে কঠোরভাবে নামিয়ে আনা সম্পর্কিত পরামর্শকেও বিবেচনায় নেওয়া হচ্ছে না।

আবারও পরামর্শ দিচ্ছি- পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা প্রয়োজন। বিশেষত, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে বলি- সময় থাকতে কঠোরভাবে পুঁজি পাচার দমন করুন। মনে রাখতে হবে- পুঁজি পাচারের প্রধান মাধ্যম হলো দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও অসাধু ব্যবসায়ী এবং ঋণখেলাপিরা। অতএব, দুর্নীতির বিরুদ্ধে 'জিরো টলারেন্স' নিয়ে শুধু কথায় চিড়ে ভিজবে না।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাবি করে থাকেন, তাঁকে কেনা যায় না। এই দাবির সত্যতা বহুবার প্রমাণ হয়েছে। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এখনও সবচেয়ে সৎ ও জনপ্রিয় রাজনীতিক। কিন্তু একই সঙ্গে জনসাধারণ দেখছে যে তাঁর দলের ও সরকারের অনেকে 'আঙুল ফুলে কলাগাছ' হচ্ছে। ক্ষমতায়, অর্থে, বিত্তে ও শান-শওকতে এই ব্যাপক স্ম্ফীতি যে দুর্নীতি ছাড়া সম্ভব হয় না, সেটি বোঝার জন্য বিশেষজ্ঞ হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাধারণ মানুষকে আমি এমন বলতেও শুনেছি যে, দুর্নীতির ব্যাপকতা বর্তমান সরকারের আমলে বিএনপি ও জাতীয় পার্টির আমল থেকে অনেক বেশি ছাড়িয়ে গেছে।

আওয়ামী লীগ যদিও টানা তিন মেয়াদে ব্যাপক উন্নয়ন করেছে, জনসাধারণের কাছে দুর্নীতিই হয়ে উঠেছে বিষফোড়া। ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও জনসাধারণ আওয়ামী লীগকে পরিত্যাগে দ্বিধা করছে না। এর কিছুটা আলামত আমরা দেখলাম অতি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত রংপুর সিটি করপোরেশন মেয়র নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জামানত হারিয়ে চতুর্থ স্থানে পৌঁছে গেছেন। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তৃতীয় হয়েছেন। এ দু'জনের প্রাপ্ত ভোটের যোগফল গত নির্বাচনের চাইতে ১০ হাজার ভোট কমে গেছে। ওই নির্বাচনে ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী দ্বিতীয় হয়েছেন। নির্বাচনে দ্বিতীয়বার জয়ী হয়েছেন জাতীয় পার্টির মেয়র।

আওয়ামী লীগ যদি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলকে ব্যতিক্রমী বাস্তবতা মনে করে, তাহলে চরম ভুল করবে- এটাই সারাদেশের আসল বাস্তবতা। সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দুর্নীতিবাজ, পুঁজি-লুটেরা এবং পুঁজি পাচারকারীদের দল হিসেবে চিহ্নিত করে মন থেকে ঝেড়ে ফেলেছে। অতএব, আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন যদি রংপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনের মতো সুষ্ঠু নির্বাচন হয়, তাহলে একই রকম বিপর্যয় আওয়ামী লীগের জন্য সারাদেশে অপেক্ষা করছে। সময় থাকতে দুর্নীতি, পুঁজি লুণ্ঠন এবং পুঁজি পাচারের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে হবে। দুর্নীতি দমন ছাড়া আগামীতে কোনো সুষ্ঠু নির্বাচনে জেতা যাবে না।

অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি