- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের আশ্বাস
সমকালীন প্রসঙ্গ
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে চীনের আশ্বাস

নতুন বছরে ইতিবাচক এমন কিছু ঘটনাপ্রবাহ আমরা দেখছি, যেগুলো রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান কিংবা প্রত্যাবাসনের দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য আশার আলো হতে পারে। শুরুতেই মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা সংকট যেমন জটিল, তেমনি এর সমাধানও কঠিন। তবে এটা ঠিক, এ সমস্যার উৎপত্তি যেখানে সেই মিয়ানমারের হাতেই এর সমাধান। এ ক্ষেত্রে মিয়ানমারের আচরণ বরাবরই অসহযোগিতামূলক। তবে এ বছরের শুরুতে ৪ জানুয়ারি মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসে দেশটির সামরিক জান্তা যেভাবে চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, লাওস ও বাংলাদেশের মতো প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজের কথা বলেছে সেটি আমাদের জন্য ইতিবাচক। ইতিবাচক এই অর্থে, মিয়ানমারের পক্ষ থেকে বিশেষ করে বর্তমান সামরিক সরকারের সময়ে এভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি আলোচনা হয়নি। মিয়ানমার প্রতিবেশী হিসেবে যেভাবে বাংলাদেশের কথা বলেছে সেটি আমাদের এক ধরনের কূটনীতির বিজয়। পাশাপাশি, আমরা দেখছি গত বছরের শেষ দিকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদেও মিয়ানমার প্রসঙ্গে একটি প্রস্তাব পাস হয়েছে, যেখানে সহিংসতা বন্ধ এবং সব রাজনৈতিক বন্দির মুক্তি চাওয়া হয়েছে। বলাবাহুল্য, ৭৪ বছরের মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদ এবারই প্রথম মিয়ানমারবিষয়ক কোনো প্রস্তাব গ্রহণ করে। একই সঙ্গে সম্প্রতি বাংলাদেশে চীনের নবনিযুক্ত রাষ্ট্রদূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের কথা বলেছেন এবং মিয়ানমারের একটি প্রতিনিধি দলের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের বিষয়টিও তাঁর আলোচনায় এসেছে। সেদিক থেকে এক ধরনের আশাবাদ স্পষ্ট।
তবে এটাও মনে রাখতে হবে, মিয়ানমারের বর্তমান পরিস্থিতি ভালো নয়। সেখানকার সামরিক সরকার চারদিক থেকে নানামুখী চাপের মধ্যে রয়েছে। দেশটি যেমন বিভিন্ন বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত, তেমনি ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে ক্ষমতা দখলের পর থেকেই গণপ্রতিরোধের মুখে পড়েছে সামরিক জান্তা। এর আগে এমনটা দেখা না গেলেও এবার আমরা ভিন্ন চিত্র দেখেছি। সেখানকার বিক্ষুব্ধ মানুষ সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সময় মাঠে থেকে লড়াই করছে। তাছাড়া, গত নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া রাজনৈতিক দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি বা এনএলডি মিয়ানমারে ছায়া সরকার গঠন করে শক্তিশালী প্রতিরোধ বাহিনী তৈরি করেছে। এই নানা ফ্রন্টের যুদ্ধের প্রভাব পড়ছে সীমান্তবর্তী দেশগুলোতে। বাংলাদেশ, ভারত, থাইল্যান্ড এমনকি চীনেও পড়ছে। সে কারণেই দেশটি সাম্প্রতিক সময়ে বারবার বাংলাদেশের আকাশসীমা লঙ্ঘন করেছে। মিয়ানমার আরাকান আর্মির সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তায় এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করেছে। সম্প্রতি বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্তের কোনারপাড়ার শূন্যরেখায় রোহিঙ্গা আশ্রয়শিবিরে মিয়ানমারের সশস্ত্র দু'পক্ষের মধ্যে গোলাগুলিও সীমান্তে সংকট তৈরি করেছে। এর আগে অবশ্য দুই দেশের মধ্যে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং মিয়ানমারের পক্ষ থেকে দুঃখ প্রকাশ করা হয়।
বাংলাদেশও তাদের ফাঁদে পা না দিয়ে সংযম প্রদর্শন করেছে। কারণ রোহিঙ্গা সংকটের সমাধান মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ মানবতার খাতিরে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে। এখন মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনই তার সমাধান। বস্তুত বাংলাদেশ ২০১৭ সাল থেকে এ লক্ষ্যে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ লক্ষ্যে ইতোমধ্যে জাতিসংঘে ৫ দফা প্রস্তাব দিয়েছেন। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে তিনি মিয়ানমারে নিরাপদ জোন তৈরির কথা বলেছেন। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেওয়ার স্থায়ী সমাধানের দাবিও করেছেন। জাতিসংঘের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক আদালতেও বাংলাদেশ সর্বোচ্চ কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। তাছাড়া দ্বিপক্ষীয়ভাবে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি আমরা। সে জন্য ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যখন রোহিঙ্গা ইস্যু কিছুটা পর্দার আড়াল হয়েছে তখনও বাংলাদেশের সোচ্চার ভূমিকায় এটি আলোচনায় রয়েছে।
রোহিঙ্গা ইস্যু আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় থাকলেও বাস্তবতা হলো এখনও প্রত্যাবাসন শুরু হয়নি। জান্তা সরকারের অসহযোগিতা ও অনমনীয় অবস্থানের কারণে এটি সম্ভব হচ্ছে না। তারপরও বাংলাদেশের প্রচেষ্টার যে ফল আসছে সেটি স্পষ্ট। শুরুতেই বলেছি জাতিসংঘের প্রস্তাবের কথা। নিরাপত্তা পরিষদে যেভাবে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে প্রস্তাব পাস হয়েছে, সেটি উল্লেখযোগ্য। চীনের সাম্প্রতিক ইতিবাচক অবস্থান এ ক্ষেত্রে প্রত্যাশা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের নতুন রাষ্ট্রদূত নিশ্চিত করেছেন, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের অভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ভূমিকা রাখারও আশ্বাস দিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সাম্প্রতিক সময়ে রোহিঙ্গা বিষয়ে আগের চেয়েও আরেকটু এগিয়ে এসেছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছে তাকে ইতোমধ্যে আমেরিকা গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। তাদের এ স্বীকৃতি যেন রোহিঙ্গাদের ন্যায়বিচারের পথ উন্মুক্ত করেছে, তেমনি তাদের সংকটের সমাধান হিসেবে প্রত্যাবাসনেও ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি তৃতীয় দেশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের আশ্রয়ের ব্যাপারে যে আগ্রহ দেখিয়েছে তারও ইতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট।
বলার অপেক্ষা রাখে না, রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান চীনের ভূমিকা দুটি কারণে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। একদিকে চীন দেশটির প্রতিবেশী এবং শক্তিধর দেশ হিসেবেও এর অবস্থান তাৎপর্যবহ। তাছাড়া, মিয়ানমারে চীনের বিশেষ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থও রয়েছে। সেজন্য এতদিন চীনের সে অর্থে কাঙ্ক্ষিত সাড়া আমরা পাইনি। তবে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের কারণে এবং দেশটির সঙ্গে দীর্ঘ কূটনৈতিক প্রচেষ্টার কারণে তার ইতিবাচক ফল এবার আমরা দেখছি। চীনের রাষ্ট্রদূত যখন প্রত্যাবাসনে ইতিবাচক মনোভাব ব্যক্ত করেছেন এবং মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের বাংলাদেশের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শনের বিষয়টি নিশ্চিত করছেন তার মানে খুব শিগগির এর প্রভাব আমরা দেখব। তাছাড়া চীন নিশ্চয়ই এটি অনুভব করছে, রোহিঙ্গা সমস্যা আঞ্চলিক নিরাপত্তায় সংকট তৈরি করবে। ইতোমধ্যে তার লক্ষণ স্পষ্ট। বিশেষ করে, রোহিঙ্গাদের জঙ্গি তৎপরতায় ব্যবহারের চেষ্টা, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে সশস্ত্র গ্রুপের অবস্থান এবং মাদক চোরাকারবারি ইত্যাদি নিরাপত্তায় যে হুমকি তৈরি করবে, সেটি গোটা অঞ্চলকেই প্রভাবিত করবে। সেজন্য চীন এমনকি ভারতকেও এগিয়ে আসতে হবে। আঞ্চলিক সংকটের সমাধান যে নিজেদেরই করতে হবে সে উদাহরণ আমরা দেখেছি, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা উভয়ে একক মুদ্রা চালুর ব্যাপারে পরিকল্পনা করছে।
সব মিলিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানের পথে নতুন বছরটি ইতিবাচক বলেই মনে হয়। আন্তর্জাতিক বিশ্বের ভূমিকা ও আঞ্চলিক সহযোগিতা অব্যাহত থাকলে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের বিদ্যমান চাপের মুখে এ ক্ষেত্রে পিছু হটার সুযোগ সামান্যই। আমরা প্রত্যাশা করি, বাংলাদেশের ইতিবাচক ও ধারাবাহিক কূটনীতি যেমন আঞ্চলিক এ সংকটের সমাধানে ভূমিকা রাখবে, তেমনি মানবতার দিক থেকেও রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর জন্য আশার আলো হয়ে থাকবে।
ড. দেলোয়ার হোসেন :অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; প্রেষণে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের (পিএসসি) সদস্য হিসেবে নিয়োজিত
মন্তব্য করুন