
উইকিপিডিয়াতে দেশি শব্দ হাপরকে ব্যাখ্যা করা হয়েছে এভাবে- 'হাপর হচ্ছে কামারদের ব্যবহূত এক ধরনের বাতাস প্রবাহিত করার ব্যবস্থা, যার দ্বারা কয়লার আগুনকে উস্কে রাখা হয়। এই আগুনে ধাতব, প্রধানত লোহা, গরম করে তাকে পিটিয়ে বিভিন্ন আকারের জিনিস তৈরি হয়।' সাধারণত বাতাস আগুন নেভায় অথবা আগুন জ্বালানোর বাধা হচ্ছে বাতাস। কিন্তু এই বাতাস আবার আগুন জ্বালাতে আর আগুন ছড়াতে সহায়তাও করে। আমরা ফুঁ দিয়ে আগুন নেভাই, আবার কখনও কখনও ফুঁ দিয়ে আগুন জ্বালাই। সম্পূর্ণ বিপরীত কর্মকাণ্ডে- ফুঁ- আগুন জ্বালাতে ও নেভাতে প্রয়োজন হয়। 'কে ফুঁ দিচ্ছেন' এবং 'কতটা ফুঁ দিচ্ছেন' আর 'কখন ফুঁ দিচ্ছেন' ও 'কী উদ্দেশ্যে ফুঁ দিচ্ছেন', তার ওপর নির্ভর করে ফুঁ-এর কার্যকারিতা। আগুন জ্বালিয়ে রাখতে ও তাপ বাড়াতে কামারের যান্ত্রিক ফুঁ হচ্ছে হাপর। মানুষের সভ্যতা এগিয়ে নিতে ধাতবের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আমরা কমবেশি সবাই জানি। এই ধাতবের ব্যবহার বহুমাত্রিক করতে কয়লা, আগুন ও হাপরের ভূমিকা কতটা তা সহজেই অনুমেয়। হাপরকে অনেকে ভস্ত্রা, ভিস্তি, মশক বলেও অভিহিত করেন। হাল আমলে হাপর সচরাচর নজরে পড়ে না। যেমন বাংলাদেশে নজরে পড়ে না অবাধ ভোট, উদার গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সুশাসন ও জনস্বস্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ চর্চাগুলো। যান্ত্রিক সুবিধা অনেক গুণ বাড়িয়ে হাপরের বিকল্প আমরা তৈরি করেছি। আদিম এই যন্ত্রটির বিকল্প তৈরি হলেও বাংলাদেশের লোকসমাজ ও রাষ্ট্র থেকে লাগসই কোনো উপযোগী ব্যবস্থা ছাড়াই সম্পূর্ণভাবে জনমত উপেক্ষা করে জগদ্দল পাথরের মতো কিম্ভূতকিমাকার এক অগণতান্ত্রিক দুঃশাসন টিকে আছে এ জনপদে, জনগণের বুকের ওপর। এই অব্যবস্থাপনা চলছে ১৫ বছরেরও অধিক কাল।
পরানের গহিনে ফ্যাসিবাদের ফাঁপর তাড়াতে আমজনতার শক্ত চোয়াল, মুঠো হাত ও বুকের হাপরে সাহসের স্ম্ফুলিঙ্গ ভীষণ জরুরি। আমাদের দেশে কোরবানিতে প্রয়োজনীয় লোহার নতুন জিনিসপত্রের চাহিদার পাশাপাশি পুরোনো ছুরি, দা-বঁটির শান দেওয়ার কাজের ব্যস্ততাও বাড়ে। বাংলাদেশের মুসলমানরা কোরবানি ঈদের আগে পুরোনো ছুরি, চাপাতি, বঁটি শান দেয় কামারশালায়। কামারপাড়ায় তখন হাপরের হাঁসফাঁস শব্দ বাড়ে। হাপর দিয়ে কয়লার আগুনে লোহা পুড়িয়ে লাল করা, ছোট-বড় নানা আকারের হাতুড়ি দিয়ে পিটিয়ে তৈরি করা ইত্যাদি কাজে কামারের ফুরসত থাকে না। তখন নতুন হাতিয়ার বানানোর পাশাপাশি পুরোনো হাতিয়ার শান দেওয়ার কাজও চলে সমানতালে। ক্লান্তিহীনভাবে চলে কাজ, কথা বলার একদম ফুরসত থাকে না কামারের। এভাবে গরমে ঘেমে-নেয়ে একাকার হন তখন কামারপট্টির কারিগররা। শহুরে ভাষায় যাঁদের লৌহশিল্পী বলা হয়। কিন্তু কামারবাড়ি শব্দটি বেশি পরিচিত। কামারবাড়ির লোহা-লক্কড়ের আওয়াজ, হাপরের ফোঁসফাঁস আর হাতুড়িপেটার টুংটাং এ সময়ের সবচেয়ে প্রিয় শব্দ। এ শব্দ আনন্দের। এ শব্দ উৎসবের।
সবকিছুরই একটি মৌসুম থাকে। ওই মৌসুমে সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের কাজের ধুম চলে। তবে আকালের মৌসুমের কথা ভিন্ন। ধান কাটার মৌসুম, মাছ ধরার মৌসুম, রমজানের মৌসুম, কোরবানির মৌসুমের মতো এ দেশে ভোটের মৌসুমও আসে। স্থানীয় ও জাতীয় যে ভোটই হোক না কেন তা মানুষের মৌসুমি আনন্দের খেলা। গত ১৫ বছরে দেশের মানুষের কাছে সেই ভোটের মৌসুম আর আসে না। এ দেশে ভোটের অধিকারহারা মানুষ তার ভোটের অধিকার ফিরে পেতে সংগ্রাম করেছে বারবার। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সূচনা ১৯৭০ সালের ভোটের ফলাফলকে কেন্দ্র করেই। ১৯৯০ সালের গণঅভ্যুত্থান নিশ্চিত করেছিল এ দেশের মানুষের ভোটাধিকার বোধ। ১৯৯৫-৯৬ সালে তৎকালীন বিরোধী দলের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান চালু করলে এ দেশের জনসাধারণ ভোটাধিকারের নিশ্চয়তা খুঁজে পায়। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের পঞ্চাশের অধিক বয়সে কেবল ১৯৯১-২০০৬ সালে তুলনামূলকভাবে দেশের মানুষ জাতীয় পর্যায়ে নির্বিঘ্নে ভোট দিতে পেরেছিল। অবাধ ও নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন ব্যবস্থা সর্বজনীন হয়ে উঠেছিল। গোলটি বাধায় ১/১১-এর সরকার। ২০০৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ অবাধে ভোট দিলেও ফলাফলে বিস্মিত হয়। ওই নির্বাচনে ভোট প্রদানের শতকরা হারও রহস্যজনকভাবে বেশি ছিল। ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে প্রদেয় ভোট যে কোনো স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের চেয়ে বেশি। আবার ২০০৯ সালের উপজেলা নির্বাচন, যা জাতীয় নির্বাচনের পরপরই অনুষ্ঠিত হয়, সে নির্বাচনে ভোট প্রদানের হার ছিল অনেক কম। এই সংখ্যাতাত্ত্বিক হিসাবগুলো দেশের মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগ আচরণের সঙ্গে গরমিলের।
আলোচনা হাপর দিয়ে শুরু করেছিলাম। পাঠক হয়তো ভাবছেন হাপর থেকে এভাবে রাজনৈতিক আলোচনা বা বিতর্কিত ইস্যু আসছে কেন! ভোট নিয়েই বা এই আলোচনার দরকার কী? এগুলো আলোচনায় আসছে এ জন্য যে, ২০২৩ সাল নির্বাচন ও আন্দোলনের ভরা মৌসুম। বছরব্যাপী চলবে এই মৌসুম। দেশে সাধারণত শীতকাল আন্দোলনের মৌসুম। চলতি শীতে বিএনপির জনসম্পৃক্ত কর্মসূচি আর তাতে মানুষের 'বাঁধ না মানা অংশগ্রহণ' শীতের উত্তাপ বাড়িয়েছিল। গত ১০ ডিসেম্বর ঘিরে যে উত্তাপ তৈরি হয়েছিল, শীত কমার সঙ্গে সঙ্গে মনে হচ্ছে, সেই উত্তাপও পড়তির দিকে। তবুও দেশবাসীর মনে আশা-নিরাশার দোলাচল। ভোট কি আদৌ হবে? হলে কীভাবে হবে। না হলে কী হবে। মানুষ অবাধে ভোটাধিকার প্রয়োগে আর কতটা রক্ত ঝরাবে! আর কত বলি হবে! কত প্রাণ কোরবানি দেবে! তবুও মিলবে কি রাষ্ট্রীয় মালিকানা, যা এ দেশের নাগরিক হারিয়েছে এক যুগের অধিক কাল আগে।
নির্ভয়ে যাকে খুশি তাকে ভোট দেবে- রাষ্ট্রের মালিকদের এই আকাঙ্ক্ষা অমূলক নয়। 'আমার ট্যাক্সের টাকায় দেশ চলে। আমার করের এই টাকা কারা খরচ করবে তা নির্ধারণ করব আমি।' খুবই ন্যায্য এই চাওয়া। সৎ চাওয়া। এই অধিকারের জন্যই আমরা রাষ্ট্র নির্মাণ করেছি। জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছি। মরেছি। তোমরা তা মনে রাখবে না জেনেও আমরা মরেছি আনন্দে কিংবা ভয়ে। এই সৎ চাওয়া পূরণে ভোটই ন্যায্য হাতিয়ার। সেই হাতিয়ার আমার চাই। এসো মানুষ হাপর হই। হাপর বানাই। হাপর চালাই। গড়ি কল্পনার জনসেবা ব্যবস্থাপনা। গণমুখী রাষ্ট্র।
জাহেদুল আলম হিটো: মানবাধিকারকর্মী
মন্তব্য করুন