
প্রতিহিংসা-প্রতিশোধ-বদলার কনসেপ্ট নতুন নয়। বিশেষ করে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা। যদি প্রশ্ন করেন, কেন এই প্রতিশোধপ্রবণতা? জবাবটা খুব সহজে এবং এককথায় দেওয়ার সুযোগ নেই। প্রতিহিংসার নানা কারণ বিদ্যমান। তবে বহু আলোচিত মতের একটি হলো- সমতা প্রতিষ্ঠার আকাঙ্ক্ষা। আমার ওপর যে অন্যায় হয়েছে, সেই অন্যায় ফিরিয়ে দিতে হবে আমাকে; অথবা যারা আমার ওপর অন্যায় করেছে, তাদের উচিত শিক্ষা দিতে হবে। এ কথা বলে অন্যায়কারীর সঙ্গে অন্যায়ের শিকার একই সমতলে দাঁড়াতে চায়। এ মনস্তত্ত্বই তাকে চোখের বদলে চোখ- এ স্লোগান উচ্চকিত করে। রাজনৈতিক আর সামাজিক মাঠে তাই সর্বত্রই আজ প্রতিহিংসা আর প্রতিশোধের দল ভারী। এসব মানুষের হীনম্মন্যতা আর পরাজয়বোধের গ্লানিই তাদের প্রতিহিংসার পেছনে ধাবিত করে।
গ্রিক দার্শনিক সক্রেটিসের মতে, অন্যায় দিয়ে অন্যায়ের প্রতিশোধ নেওয়া অথবা যে কেউ আমাদের ক্ষতি করে, উল্টো তার ক্ষতি করা কখনও ন্যায়সংগত কাজ নয়। কিন্তু সে কথা আজকের রাজনৈতিক বাস্তবতায় কে শুনছে? চারদিকে শুধু ক্রোধের প্রবল আকর্ষণ- প্রতিহিংসার নিয়ত উদযাপন। সারা দুনিয়ার রাজনীতির চিত্রটা একটু দেখা যাক। সারা দুনিয়ার সাধারণ মানুষ ক্রমশই যেন উগ্র দক্ষিণপন্থার দিকে ঝুঁকছে। ধনী দেশ, দরিদ্র দেশ, নির্বিশেষে সর্বত্রই এ প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প জমানা থেকে শুরু করে রিপাবলিকান দল, ব্রিটেনে ব্রেক্সিটের সমর্থক গোষ্ঠী, ফ্রান্সে অতি দক্ষিণপন্থি মারিন ল্য পেন এবং জার্মানিতে নব্য-নাৎসি প্রভাবিত এএফডি নিজ নিজ দেশে প্রধান বিরোধী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। ইতালি, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ডে এখন উগ্র দক্ষিণপন্থিদের শাসন চলছে। সুইডেনে সরকারের ক্ষমতার সঙ্গী এবং সমর্থক এক নব্য-নাৎসি দল।
উন্নয়নশীল দেশের চিত্রও অনেকটা ঠিক একই রকম। তুরস্কে এরদোয়ান, ভারতে নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায়। ব্রাজিলে দক্ষিণপন্থিরা লুলা দা সিলভার কাছে হারলেও তাদের নেতা বোলসোনারো পেলেন ৪৯ দশমিক ২ ভাগ ভোট। অনেকেই মনে করেন, দুনিয়াজুড়ে আর্থিক অসাম্য এত বাড়ছে, এর প্রতিক্রিয়ায় দক্ষিণপন্থিদের প্রতি মানুষের সমর্থন বাড়ছে। দুনিয়াজুড়ে বামপন্থি শ্রমিক সংগঠনের জোর কমেছে। একসময় দক্ষিণপন্থি রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলায় শ্রমিক সংগঠনগুলোর বড় রকম ভূমিকা ছিল, যা আজ অনুপস্থিত।
এ পরিস্থিতির সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে গেছে মানুষের সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তা। বিশেষ করে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়া-ইউরোপে শরণার্থী সংকট সাংস্কৃতিক অনিশ্চয়তা সৃষ্টি করেছে। স্থানীয়দের আশঙ্কা, সম্পূর্ণ ভিন্ন সংস্কৃতির শরণার্থীরা এলে তাদের সনাতন সংস্কৃতির ক্ষতি হবে। এ অনিশ্চয়তা রাজনৈতিকভাবে কাজে লাগাচ্ছে দক্ষিণপন্থি রাজনীতি। তারা সুকৌশলে হাজার বছরের পুরোনো ইতিহাস ঘেঁটে নতুন বিদ্বেষ তৈরি করছে এবং সনাতন সমাজে ছড়িয়ে দিচ্ছে। ভারতে এর উদাহরণ অসংখ্য।
বিশ্ববাসীকে ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ রাজনীতির কথা, মানুষের কথা। যদি সংস্থায় সংস্থায়, কারখানায় কারখানায় শ্রমিক-কর্মচারীদের মধ্যে ধর্ম সম্প্র্রদায়ের ভিত্তিতে বিভাজনের বিষ, ঘৃণা আর বিদ্বেষ ছড়িয়ে দেওয়া হয়- বিভেদের ঘুণ যদি কুরে কুরে খায় আমাদের মানবিক সংহতি, তবে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতি কীভাবে নিশ্চিত হবে? রাজনীতি আর সামাজিক পরিসরে যদি হিংসা-দাঙ্গা-হানাহানি নিত্য জারি থাকে, তবে কারখানা এবং পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থার উৎপাদনশীলতা কীভাবে অগ্রগতির মুখ দেখবে? বিনষ্ট সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতি আমাদের শ্রীকেই কেবল নস্যাৎ করে তা নয়! সেটা আমাদের বৃদ্ধি ব্যাহত করে, আমাদের অগ্রগতিকেও পেছনের দিকে এগিয়ে দেয়।
২০২৪ সালের শুরুতে আমাদের পরবর্তী নির্বাচন। এজন্য চলতি বছর আমরা চাই এমন বাংলাদেশ- যেখানে রাজনৈতিক হানাহানি আর দাঙ্গার আর্তনাদ বাতাস ভারাক্রান্ত করবে না, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে সামাজিক শত্রু চিহ্নিত হবে না, মিথ্যা প্রচারের ভিত্তিতে জেগে ওঠা অযৌক্তিক উন্মাদনার বিকৃত রূপ পুড়িয়ে ছাই করে দেবে না কোনো শান্তির কুটির। ২০২৩-এ চাই মানবতার নিরিখে রাজনীতির নতুন রসায়ন- যে রাজনীতি সমাজকল্যাণের সিমেন্ট দিয়ে মেরামত করে দিতে পারবে ভাঙতে বসা সামাজিক সংহতির সদন। বদলা নয়, বদল চাই রাজনীতিতে- রাজনৈতিক চিন্তায়।
সুধীর সাহা: কলাম লেখক
মন্তব্য করুন