- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- 'সর্বজনীন পেনশন স্কিম' কতটুকু সর্বজনীন
সামাজিক সুরক্ষা
'সর্বজনীন পেনশন স্কিম' কতটুকু সর্বজনীন

সম্প্রতি দেশের সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিককে পেনশন ব্যবস্থার আওতায় আনতে জাতীয় সংসদে বিল পাস করা হয়েছে। এই বিলটির নাম 'সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনা বিল-২০২৩'। রাজনৈতিক সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে এমন বিলের দেখা গেল বলা যায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই পেনশন কতটা সর্বজনীন হয়ে উঠল তা যাচাই করতে হবে। নামে সর্বজনীন বললেই হবে না, প্রমাণ দেখাতে হবে। আবার এটি বিদ্যমান ব্যবস্থায় নতুন কিছু কিনা, তাও বিচার করতে হবে।
প্রথম কথা হলো, এ ধরনের উদ্যোগ প্রশংসনীয়। যদি সত্যি সত্যিই সব নাগরিককে এরকম সুবিধার আওতায় আনা যায় তাহলে তা সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের সামাজিক সুরক্ষাকেই শুধু শক্তিশালী করবে না, জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গেও সাযুজ্যপূর্ণ হবে। বর্তমানে দেশের শ্রমশক্তির অন্তত ৮৫ শতাংশ অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে কাজ করে, যেখানে নিয়মিত মজুরি বা ভাতাই জোটে না, অবসরভাতা তো দূরের কথা। আবার সামাজিক পরিবর্তনের কারণে পরিবারগুলোও আর আগের কাঠামোতে থাকছে না। আমাদের সনাতন পারিবারিক কাঠামোয় বয়স্কদের সব ধরনের দায়িত্ব পরিবারের তরুণ সদস্যরাই নিয়ে থাকেন। কিন্তু দিনে দিনে এ ব্যবস্থা এবং তৎসম্পর্কিত মূল্যবোধেও পরিবর্তন আসছে। উপরন্তু, মানুষের গড় আয়ুও ক্রমশ বাড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে, বেঁচে থাকার জোগাড়-যন্তর অনেকাংশে বয়স্কদের নিজেদেরই করতে হচ্ছে। এ মানুষদের জন্য সর্বজনীন পেনশন স্কিম একটা বড় ধরনের ভরসা জোগাতে পারে।
কিন্তু সর্বজনীন পেনশন স্কিমটি বর্তমানে যে অবস্থায় আছে তা সাধারণ মানুষের সাড়া পাবে বলে মনে হয় না। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীরা যেভাবে পেনশন পান, তার সঙ্গে প্রস্তাবিত সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অনেক কিছুই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। মানুষ রিটার্ন কীভাবে পাবে, তা পরিস্কার নয়। এটা অনেকটা ব্যাংকিং প্যাকেজের মতো। এই বিল পাসের আগে সাধারণ মানুষের মতামত নেওয়া উচিত ছিল। বিলের কথাগুলো ভালো। কিন্তু বিদ্যমান রূপে এটা অনেকটা ব্যাংকের ডিপোজিট পেনশন স্কিম বা ডিপিএসের মতো। গুঞ্জন আছে, চলার মতো অর্থের সংস্থান না থাকার কারণে সরকার জনগণের কাছ থেকে টাকা তোলার জন্য এমন পদক্ষেপ নিয়েছে: অর্থের অভাবে অনেক প্রকল্পই সরকার স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছে। বিষয়টা পরিস্কার করার দায় সরকারের।
আমরা জানি, বর্তমানে শুধু সরকারি কর্মচারীরা অবসরের পর পেনশন সুবিধা পান। এই বিল পাস হওয়ার ফলে সবার জন্য পেনশন স্কিম চালু করার আইনি ভিত্তি তৈরি হলো। কোনো ব্যক্তিকে মাসিক পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে; যা-আগেই বলা হয়েছে- অনেকটা ব্যাংকের ডিপিএসের মতো। জনগণ চাঁদা দেওয়ার পর সরকার কী পরিমাণ অর্থ দেবে, সরকারের অংশগ্রহণ কী হবে, তা আইনে পরিস্কার নয়। এই আইন সংবিধানের সঙ্গে কতটা সম্পর্কযুক্ত কিংবা সাংঘর্ষিক তাও নিরূপণ করতে হবে।
সংবিধানে বলা হয়েছে, সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার, অর্থাৎ বেকারত্ব, ব্যাধি বা পঙ্গুত্বজনিত কিংবা বৈধব্য, মাতৃপিতৃহীনতা বা বার্ধক্যজনিত কিংবা অনুরূপ অন্যান্য পরিস্থিতিজনিত কারণে অভাবগ্রস্ত হলে তার ক্ষেত্রে সরকারি সাহায্য লাভের অধিকার থাকবে। এটা নাগরিকের অধিকার। কিন্তু এই আইনে বলা হচ্ছে, মানুষের কাছ থেকে চাঁদা নিয়ে সরকার তা আবার ফেরত দেবে-যাও আবার শর্তযুক্ত। তাই এ পেনশন স্কিমের চরিত্র সম্পর্কে প্রথমেই সন্দেহ পোষণ করা যায়।
সরকারের এই সর্বজনীন পেনশন বিল যতটুকু দেখেছি তাতে বলা হয়েছে, জাতীয় পরিচয়পত্রকে ভিত্তি ধরে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় ১৮ বছর বা এর বেশি বয়স থেকে ৫০ বছর বয়সী সব বাংলাদেশি নাগরিক অংশ নিতে পারবেন। পঞ্চাশোর্ধ্ব নাগরিকদের কী দেবে এ স্কিম? বলা হয়েছে, বিশেষ বিবেচনায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিদেরও পেনশন স্কিমের আওতায় রাখা হবে। তবে এ ক্ষেত্রে মাসিক পেনশন সুবিধা পেতে সর্বজনীন পেনশন ব্যবস্থাপনায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর চাঁদাদাতাকে ধারাবাহিকভাবে কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দিতে হবে। ১০ বছর চাঁদা দেওয়া শেষে তিনি যে বয়সে উপনীত হবেন, সে বয়স থেকে আজীবন পেনশন পাবেন। এখানেও চাঁদার হার কত হবে, তা নির্ধারণ করা হয়নি। আইনে বলা হয়েছে, চাঁদাদাতার বয়স ৬০ বছর পূর্তিতে পেনশন তহবিলে পুঞ্জীভূত মুনাফাসহ জমার বিপরীতে পেনশন দেওয়া হবে। একজন পেনশনার আজীবন পেনশন সুবিধা পাবেন। এখন এটার আইন হলে এবং সরকারি গেজেট জারি হলে তখন কী উল্লেখ থাকে তা দেখা যাবে। আপাতদৃষ্টে এই আইনটি ভালো। কিন্তু বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যেভাবে প্রভিডেন্ট করে, এটি তার বাইরে কিছু বলে মনে হয় না। সরকার কী মুনাফা দেবে, তা পরিস্কার নয়।
বিলে বলা হয়েছে, পেনশনে থাকাকালে কোনো ব্যক্তি ৭৫ বছর পূর্ণ হওয়ার আগে মারা গেলে তাঁর নমিনি অবশিষ্ট সময়ের জন্য (মূল পেনশনারের বয়স ৭৫ বছর পর্যন্ত) মাসিক পেনশন প্রাপ্য হবেন। চাঁদাদাতা কমপক্ষে ১০ বছর চাঁদা দেওয়ার আগে মারা গেলে জমাকৃত অর্থ মুনাফাসহ তাঁর নমিনিকে ফেরত দেওয়া হবে। পেনশন তহবিলে জমা দেওয়া অর্থ কোনো পর্যায়ে এককালীন তোলার প্রয়োজন পড়লে চাঁদাদাতা আবেদন করলে জমা দেওয়া অর্থের সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ ঋণ হিসেবে তুলতে পারবেন, যা ফিসহ পরিশোধ করতে হবে। পেনশন থেকে পাওয়া অর্থ আয়করমুক্ত থাকবে। পেনশনের জন্য নির্ধারিত চাঁদা বিনিয়োগ হিসেবে গণ্য করে কর রেয়াতের জন্য বিবেচিত হবে।
বিলে বলা হয়েছে, নিম্ন আয়সীমার নিচের নাগরিকদের অথবা অসচ্ছল চাঁদাদাতার ক্ষেত্রে পেনশন তহবিলে মাসিক চাঁদার একটি অংশ সরকার অনুদান হিসেবে দিতে পারবে। বিলে সর্বজনীন পেনশন পদ্ধতিতে সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত অথবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশ নেওয়ার সুযোগ রাখা হয়েছে। এ ক্ষেত্রে কর্মী ও প্রতিষ্ঠানের চাঁদার অংশ কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করবে। তবে সরকার সিদ্ধান্ত না দেওয়া পর্যন্ত সরকারি ও আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা এই পেনশন ব্যবস্থার আওতাবহির্ভূত থাকবেন।
আমরা স্মরণ করতে পারি, সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা বাজেটে বিভিন্ন খাতে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য ভাতার ব্যবস্থা থাকলেও সেটা নামমাত্র। কৃষকদের জন্য পেনশনের ব্যবস্থা চালু করা প্রয়োজন। এটা তাঁদের জন্য কোনো দয়া, দান-দাক্ষিণ্য নয়, এটা তাঁদের অধিকার। অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, আইসল্যান্ডের মতো পৃথিবীর অনেক উন্নত দেশ তো বটেই, অনেক উন্নয়নশীল দেশেও এমন ব্যবস্থা চালু আছে। এমনকি প্রতিবেশী ভারতেও কোনো কোনো রাজ্যে ইউপিএস নামে এ ধরনের পেনশন সুবিধা চলছে।
আমাদের আর্থিক খাত সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানের কোনো কার্যক্রম দৃশ্যমান হচ্ছে না। এমন বাস্তবতায় এই বিলে বলা হয়েছে পেনশন কর্তৃপক্ষ গঠন করা হবে। যাকে কিনা একটি জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ নামে অভিহিত করা হয়েছে। একজন নির্বাহী চেয়ারম্যান ও চারজন সদস্য থাকবেন এখানে। আবার তাঁদের নিয়োগ করবে সরকার। তার মানে রাজনৈতিকভাবে দলীয় সরকারের ইচ্ছার প্রতিফলনই এখানে ঘটবে। কর্তৃপক্ষকে কে আবার মনিটর করবে, এটাই আসল প্রশ্ন। ১৬ সদস্যের একটি পরিচালনা পর্ষদ গঠনের বিধান রাখা হয়েছে। এর চেয়ারম্যান হবেন অর্থমন্ত্রী। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর; আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব থাকার কথা বলা হয়েছে। এখন কথা হচ্ছে- এরা থাকলেই কি সব এক দিনে বদলে যাবে? সর্বজনীন নামের ফাঁকির বিষয়েও আমাদের কথা বলতে হবে।
সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ক্ষেতমজুরসহ গ্রামীণ শ্রমজীবীদের জন্য বিশেষ সুবিধা দিতে হবে। বৃদ্ধ বয়সে সরকারি কর্মকর্তাদের আমরা যেমন আর্থিক নিরাপত্তা দিচ্ছি, তেমনি যাঁরা ক্ষেতখামারে গায়েগতরে খেটে আমাদের সেবা দিচ্ছেন, তাঁদের বৃদ্ধ বয়সের আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমজীবীদের স্বার্থের কথা ভেবে মাঠপর্যায়ে তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। তাঁদের জন্য জমাবিহীন পেনশন সুবিধা দিতে হবে। তাহলেই এই পেনশনকে সর্বজনীন পেনশন বলা যাবে।
এম এম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন