- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- ঊন উৎসব
ঊন উৎসব
দেশের বিভিন্ন এলাকায় বুধবার অনুষ্ঠিত জাতীয় সংসদের ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির যে চিত্র পরিস্ম্ফুট, উহা আমাদের উদ্বিগ্ন না করিয়া পারে না। বেসরকারি ফলাফলের হিসাবে দেখা যাইতেছে, আসনগুলিতে গড় ভোটের হার ২৯ শতাংশেরও নিল্ফেম্ন। বিএনপির সংসদ সদস্যগণের পদত্যাগের কারণে শূন্য ঘোষিত এই সকল আসনে নির্বাচন লইয়া জনপরিসরে যদিও আলোচনায় ঘাটতি ছিল না; ভোটের বাক্সে উহার প্রতিফলন স্পষ্টতই ঘটে নাই। অথচ গত মাসের প্রথম সপ্তাহে অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ উপনির্বাচনে প্রবল শৈত্যপ্রবাহের মধ্যেও ভোটার উপস্থিতির হার ৩৮ শতাংশ অতিক্রম করিয়াছিল। আলোচ্য ছয় আসনে ঘোষিত ভোটের হার লইয়া বিরোধী দল ও প্রার্থীগণ যে সকল প্রশ্ন উত্থাপন করিতেছেন, উহাও উড়াইয়া দিবার অবকাশ নাই। স্বীকার করিতে হইবে, ভোটার 'আকর্ষণ' করিতে নির্বাচন কমিশনের প্রচেষ্টা কম ছিল না। কিন্তু প্রায় সকল ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীন দল এবং কোথাও কোথাও প্রশাসনের কারণে ভোটারগণ ভোট প্রদানে দৃশ্যত 'বিকর্ষণ' বোধ করিয়াছেন। অস্বীকার করা যাইবে না, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি উপনির্বাচন ছয়টিতে অংশগ্রহণ না করায় ভোটারের বৃহৎ অংশের উৎসাহ হারাইয়া ফেলা বিচিত্র নহে। কিন্তু যাঁহারা ভোটকেন্দ্রে গিয়াছেন, তাঁহাদের সকলেও স্বস্তিতে যে ভোটাধিকার প্রয়োগ করিতে পারেন নাই; সমকালসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে তাহা স্পষ্ট। বিশেষত ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনে ভোটের গোপন বুথে যেরূপে ক্ষমতাসীন দলের আশীর্বাদপুষ্ট প্রার্থীর পক্ষে 'ভূত' দেখা গিয়াছে, তাহা অনেক বার্তাই বহন করে। আমরা মনে করি, ক্রমেই ভোটার উপস্থিতি হ্রাস পাইবার এই চিত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য স্বস্তিকর হইতে পারে না।
স্থানীয় সরকার কিংবা কেন্দ্রীয়- যেই ভোটই হউক না কেন, ভোটদানে ভোটারের এইরূপ অরুচি বাংলাদেশে এক দশক পূর্বেও ছিল অনেকটা অবিশ্বাস্য। আরও উদ্বেগের বিষয়- ইহা লইয়া ক্ষমতাসীন মহল চিন্তিত বলিয়া প্রমাণ মিলিতেছে না। অন্যথায় নির্বাচন প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য করিয়া তুলিতে খোদ নির্বাচন কমিশনের আন্তরিক প্রচেষ্টা, বিরোধী দলের আন্দোলন এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ সত্ত্বেও ভোটার নিরুৎসাহিত করিবার যাবতীয় আয়োজন কীভাবে সম্পন্ন হইতে পারে? এই ব্যাপারে আমাদের সন্দেহ সামান্য যে, মাঠ পর্যায়ের প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন দলের স্থানীয় নেতাকর্মী আন্তরিক হইলে নির্বাচনে অনিয়ম উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাসকরণ সম্ভব। আর তাহাতে ভোটারগণের উৎসাহ বৃদ্ধি বৈ হ্রাস পাইবে না। ইহাও স্মরণে রাখিতে হইবে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অগ্রসরমান। নির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির এই হার যদি ঐ নির্বাচনের 'পূর্বাভাস' হইয়া থাকে, তাহা হইলে বহু পক্ষকেই প্রমাদ গুনিতে হইবে। বস্তুত নির্বাচন কমিশন কিংবা সরকারের আন্তরিকতার অভাবে যদি এইরূপে ভোটার উপস্থিতি হ্রাস পাইতে থাকে, তাহা হইলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ভরসার কাচের দেয়ালটিও যেন ভাঙ্গিয়া পড়িবে।
আমরা মনে করি, ছয়টি আসনের উপনির্বাচনে ভোটার উপস্থিতির হার ও বিভিন্ন মাত্রার অনিয়ম আমাদের সকলের জন্যই 'ওয়েকআপ কল'। এই দেশে ভোট সাধারণ মানুষের জন্য 'উৎসব' বিবেচিত হইয়া থাকে। দুর্ভাগ্যবশত, নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় এই 'ভোট উৎসব' হারাইয়া যাইবার উপক্রম। এখন ভোটারের যেরূপ উপস্থিতি দৃশ্যমান, উহাকে 'ঊন উৎসব' বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। এই ধারা অব্যাহত থাকিলে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা ও জনপ্রতিনিধিত্বের জন্য দীর্ঘ মেয়াদে আরও কুফল বহিয়া আনিতে পারে। বস্তুত নির্বাচনগুলিতে ক্রমহ্রাসমান ভোটার উপস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা সম্ভব হইবে- এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশন তো বটেই, সময় থাকিতে সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলকেও ভাবিতে হইবে। আমরা চাহি- অনাকাঙ্ক্ষিত এই ছায়া হইতে বাংলাদেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়া বাহির হইয়া আসিবে। সেই ক্ষেত্রে অনিয়ম করিবার সকল প্রবণতা পরিহার করিতেই হইবে। এতে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবিশেষের লাভ হইলেও দল ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হইয়া থাকে। সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হইয়া থাকে রাষ্ট্রব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা। একই সঙ্গে ভোটারদের আস্থা ফেরাইতে অবাধ প্রচারণা, সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করিবার বিকল্প নাই।
বিষয় : সম্পাদকীয়
মন্তব্য করুন