জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বৈষম্যহীন এবং সমতাভিত্তিক ক্রীড়াঙ্গনের কথা বলেতেন। বলতেন তারুণ্যনির্ভর ক্রীড়াঙ্গনের কথা, যারা সাহসী এবং অফুরন্ত প্রাণশক্তির অধিকারী। তরুণদের সুপ্ত প্রতিভা চিহ্নিত করে সঠিক নির্দেশনার মাধ্যমে কাজে লাগাতে পারলে এ চত্বরের সক্ষমতাই শুধু বাড়বে না; সার্বিকভাবে ছবি পাল্টে যাবে! তিনি আরও বলতেন, তরুণরা জেগে উঠলে বাঙালির ক্রীড়াঙ্গন জেগে উঠবে। কর্মকৌশল ঠিক করে তৃণমূল থেকে কাজ শুরু করলে ফল পাওয়া যাবে।
বাস্তবতা হলো, আমাদের ক্রীড়াঙ্গনের পথচলা যেভাবে উচিত ছিল, সেভাবে না হয়ে অন্যদিকে চলে গেছে। ৫১ বছরেও ক্রীড়াঙ্গন উপযোগী একটি পূর্ণাঙ্গ ক্রীড়ানীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয়নি বিভিন্ন সমস্যার কারণে। এক যুগেরও বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ গেমসের আয়োজন করা হয়নি। অথচ এই গেমসের মাধ্যমে বিভিন্ন খেলার হালহকিকত এবং ক্রীড়াঙ্গনের সার্বিক অবস্থা আঁচ করা সম্ভব। ক্রীড়াঙ্গনে কোন কোন খেলা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিচালিত হবে, এটিও নির্ণয় করা সম্ভব হয়নি। ক্রীড়াঙ্গনে সমন্বয়হীনতায় অনেক উদ্যোগ বিলম্বিত হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গন কোন দিকে যাচ্ছে, কোন দিকে যাওয়া উচিত, এ নিয়েও রয়েছে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব।

ক্রীড়াঙ্গনে মুক্ত আলোচনার সুযোগ নেই। এটি দুর্ভাগ্যের বিষয়। এ চত্বরে গবেষণাধর্মী কার্যকলাপ উপেক্ষিত। অপ্রিয় শোনালেও সত্যি, ক্রীড়াঙ্গন ও ক্রীড়াচর্চা নিয়ে নাগরিক সমাজের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য নয়। হাতে গোনা কয়েকজন ক্রীড়া লেখক ও বিশ্নেষক ক্রীড়াঙ্গনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লেখালেখি করেন। এ ক্ষেত্রেও সুযোগ সীমাবদ্ধ। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্রীড়াবার্তা পরিবেশকদের দায়িত্ব তো নির্দিষ্ট এবং অন্যরকম।
সময় অনেক নষ্ট হয়ে গেছে সত্যি। তারপরও পরিবর্তন করা সম্ভব। বিশ্বাস করি, বাস্তবধর্মী চিন্তাশীল কর্মসূচি নির্ধারণ এবং সেটি বাস্তবায়নে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে অনেক কিছু সম্ভব। সম্মিলিত প্রয়াস তো পরাজিত হয় না। ইচ্ছাশক্তিই বড়। ক্রীড়াঙ্গনের চ্যালেঞ্জ ও সীমাবদ্ধতা দেখে দমে গেলে চলবে না। আস্থাহীনতা থেকে ক্রীড়াঙ্গনকে মুক্ত করতে হবে।

এটি ঠিক, ক্রীড়াঙ্গন এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সংযুক্ত। সচেতনতা বাড়ছে। আগের চেয়ে বেশি মানুষ ক্রীড়া কর্মকাণ্ডে উৎসাহ দেখাচ্ছে। ২০২০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট দল যুব বিশ্বকাপ ক্রিকেটে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে।
বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব সৈয়দ সাহেদ রেজা বলেছেন, ক্রীড়ানুরাগী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত উৎসাহ, নির্দেশ এবং তাঁর সর্বাত্মক সহযোগিতায় ২০১৩ সালে আয়োজন করা হয়েছে অষ্টম বাংলাদেশ গেমস। এই জাতীয় গেমস দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে নাড়া দিতে সক্ষম হয়েছে। দেশের খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের উজ্জীবিত করেছে।

ইন্টারন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি (আইওসি) সব সময় তরুণদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে। তাদের নিয়ে ভাবে। প্রতিটি দেশের এনওসিকে (ন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি) তরুণ ও যুবকদের নিয়ে কাজ করতে বলে। কয়েক বছর আগে শুরু হয়েছে যুব অলিম্পিক গেমস। লক্ষণীয় বিষয় হলো, যুব অলিম্পিকে অংশ নেওয়া প্রতিযোগী এবং প্রতিযোগীদের মধ্য থেকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রতিবারই গলায় মেডেল ঝোলাচ্ছেন; দেশের হয়ে ভালো ফল করছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ক্রীড়াঙ্গনে সব সময় তরুণদের শক্তি ও সামর্থ্যের বহিঃপ্রকাশের কথা বলেছেন। বিভিন্ন কারণে দেশব্যাপী এক দল তৃণমূল থেকে শুরু করে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত তরুণদের সম্পৃক্ত করে বৃহৎ প্রতিযোগিতার আসরের কথা ভাবা হয়নি। ভাবা হয়নি যুবক ও যুবতীদের নিয়ে ক্রীড়া উৎসবের কথা। এতে অনেক মেধার অপচয় হয়েছে। ক্রীড়াঙ্গন তাদের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারেনি।

২০১৮ সালে বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের উদ্যোগে এবং উপজেলা, জেলা, বিভাগ এবং বিভিন্ন খেলায় ফেডারেশন বা অ্যাসোসিয়েশনের কর্মকর্তাদের সর্বাত্মক সহযোগিতায় দেশের সবচেয়ে বড় ক্রীড়ার আসর 'যুব গেমস' অনুষ্ঠিত হয়েছে সফলভাবে। স্বাধীন দেশে ক্রীড়াঙ্গনের ৫১ বছরের ইতিহাসে এটি সবচেয়ে কার্যকরী ও স্মরণীয় উদ্যোগ। এর পেছনেও আছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কমিটমেন্ট, নির্দেশনা, অনুপ্রেরণা এবং গেমস সফল করার জন্য সব ধরনের সার্বিক সহায়তা।
প্রথমবারের মতো আয়োজিত যুব গেমসে ২১টি খেলার ডিসিপ্লিনে অংশ নিয়েছেন ছেলে ও মেয়ে খেলোয়াড়, ক্রীড়াবিদ, কর্মকর্তা, মিট ও টেকনিক্যাল অফিসিয়াল, সংশ্নিষ্ট অন্যরাসহ প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। অলিম্পিকের মহাসচিব বলেছেন, প্রথম যুব গেমস থেকে অনেক নতুন মুখ উঠে এসেছে। আদতে এই গেমস তো প্রতিভা অন্বেষণের উৎকৃষ্ট ক্ষেত্র। এই আসর আয়োজনের যথার্থতা প্রমাণিত হয়েছে ২০১৯ সালের সাউথ এশিয়া গেমসে। এদের অনেকেই এসএ গেমসে সাফল্য পেয়েছেন। অনেকে সাফল্যের দোরগোড়ায় পৌঁছেছেন। প্রথমবারের মতো বিদেশের মাটিতে সবচেয়ে বেশি পদক জয় সম্ভব হয়েছে। এর স্বীকৃতিও বাংলাদেশ পেয়েছে। বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব অ্যাসোসিয়েশন অব ন্যাশনাল অলিম্পিক কমিটি অ্যাওয়ার্ডে ভূষিত হয়েছেন। এই সম্মান গোটা বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের।
প্রথম যুব গেমস থেকে বাছাই করা ৩৬ জন ছেলে ও মেয়ে ক্রীড়াবিদ বিকেএসপিতে প্রশিক্ষণের সুযোগ পেয়েছে। ২৫০ জনের বেশি ছেলে ও মেয়ে বিভিন্ন সার্ভিসেস দলে এবং সংস্থায় চাকরি পেয়েছে। গত চার বছরে পর্যবেক্ষণে উঠে এসেছে প্রথম যুব গেমসে যারা অংশ নিয়েছিল, তাদের উল্লেখযোগ্য সংখ্যক এখন আগামীর সবচেয়ে বড় ভরসা- আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গনে।

বাংলাদেশ অলিম্পিক অ্যাসোসিয়েশন সবার সম্মতিতে দ্বিতীয় যুব গেমস-২০২৩ নামকরণ করেছে 'শেখ কামাল বাংলাদেশ যুব গেমস'। কামাল ছিলেন বাংলাদেশের আধুনিক ক্রীড়াঙ্গনের রূপকার। তিনি ক্রীড়াঙ্গনে তারুণ্য ও যৌবনের প্রতীক। শেখ কামাল যুব গেমস গত জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে শুরু করে প্রথম আন্তঃউপজেলা, দ্বিতীয় পর্ব আন্তঃজেলা এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। এবার ২৪ খেলার ডিসিপ্লিনে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে বাঁধনহারা যুব উৎসবের সঙ্গে সম্পৃক্ত। চূড়ান্ত পর্ব বিভাগ নিয়ে অনুষ্ঠিত হবে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৪ মার্চ ঢাকায়। গেমসের মশাল আসবে শেখ কামালের জন্মস্থান টুঙ্গিপাড়া থেকে। আনুষ্ঠানিকভাবে চূড়ান্ত পর্বের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উপস্থিত থেকে তরুণদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস ব্যক্ত করবেন।

ইকরামউজ্জমান: সাবেক সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া