ঢাকার বাতাসের শোচনীয় দূষণের বিষয় এখন কাহারও অজানা নহে। সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী আন্তর্জাতিক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান আইকিউ এয়ার সরবরাহকৃত তথ্য অনুসারে, গত জানুয়ারি মাস, তৎসহিত চলমান ফেব্রুয়ারি মাসেও দিবসের অধিকাংশ সময় এই নগরীর এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স-একিউআই স্কোর ২৫০-এর ঊর্ধ্বে থাকিতেছে। এমনকি কদাচ তাহা ৩০০ অতিক্রম করিতেছে, যথায় এই স্কোর ১৫০-২০০ হইলে অস্বাস্থ্যকর, ২০১-৩০০ হইলে অতি অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর অধিক হইলে বায়ুদূষণকে বিপজ্জনক বলিয়া চিহ্নিত করা হয়। অধিকন্তু এই সময়ে ঢাকা বহুবার বিশ্বের সর্বাধিক দূষিত বায়ুর শহরের আখ্যা পাইয়াছে। কিন্তু দুঃখজনক, যে সকল সরকারি কর্তৃপক্ষের এই বিপদ হইতে রাজধানীবাসীকে সুরক্ষা দিবার কথা, উহারা অদ্যাবধি গভীর নিদ্রায় মগ্ন। অন্তত রবিবার উচ্চ আদালতের দেওয়া এই সংক্রান্ত এক রায়ের পর এমন ধারণা পোষণে কাহাকেও শাস্তি দেওয়া যাইবে না। সোমবার সমকালের এক প্রতিবেদনে যেমন উল্লেখ করা হইয়াছে, রোববার আদালত তিন বৎসর পূর্বে ঢাকার বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে দেওয়া উহার ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়ন না করায় সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশ করিয়াছেন। আরও স্বস্তিদায়ক হইল, আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে উক্ত নির্দেশনাসমূহ বাস্তবায়নপূর্বক আদালতের নিকট প্রতিবেদন জমা দিতে পরিবেশ অধিদপ্তর, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন, পুলিশ মহাপরিদর্শক ও রাজউককে নির্দেশ প্রদান করা হইয়াছে। উল্লেখ্য, একজন আইনজীবীর আবেদনের ভিত্তিতে ২০২০ সালের ১৩ জানুয়ারি উচ্চ আদালত উক্ত ৯ দফা নির্দেশনা জারি করেন। গত মাসে ঢাকা পরপর কয়েক দিবস বায়ুদূষণে বিশ্বের শীর্ষতম অবস্থানে থাকিবার পরিপ্রেক্ষিতে আদালত ৩১ জানুয়ারি উক্ত ৯ দফা নির্দেশনার বাস্তবায়ন পরিস্থিতি তাহাকে অবহিত করিতে বিবাদীপক্ষকে নির্দেশ দেন। উহারই ধারাবাহিকতায় বিষয়টা রবিবার শুনানির জন্য আদালতের কার্যতালিকায় আসে।

ঢাকা ও পার্শ্ববর্তী এলাকাসমূহে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করিয়া যে বহুবিধ নির্মাণকাজ চলমান, উহাতে অবশ্য নগরীর বাসিন্দাদের স্বাস্থ্যকর বাতাস পাইবার কোনো কারণ নাই। একদিকে আবাসিক এলাকাসমূহে, বিশেষত নির্মাণাধীন ভবনসংলগ্ন ফুটপাত বা রাস্তায় বালুসহ বিভিন্ন নির্মাণসামগ্রী স্তূপ করিয়া রাখা হয়; অন্যদিকে প্রায় বৎসরব্যাপী চলে উন্নয়নের নামে বিভিন্ন সরকারি পরিষেবা সংস্থার পালাক্রমে সড়ক খনন কার্যক্রম। কয়েক বৎসর ধরিয়া চলিতেছে ফ্লাইওভার, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল ইত্যাদি নির্মাণযজ্ঞ, যথায় পরিবেশের বিষয় প্রায় অনুপস্থিত বলিলে অত্যুক্তি হইবে না। ঢাকার চতুষ্পার্শ্বের শত-সহস্র ইটভাটা কী ও কত প্রকারে নগরীর বায়ুদূষণে বিশেষ ভূমিকা রাখিতেছে, উহা লইয়া মাঝেমধ্যে সমকালসহ মুদ্রণ ও বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ইহার বিরুদ্ধে বিশেষ করিয়া পরিবেশকর্মীরা উচ্চকণ্ঠ। এমনকি উচ্চ আদালতের যে ৯ দফা নির্দেশনার কথা বলা হইল, উহাতেও ঐ সকল পরিবেশ দূষণকারী ইটভাটার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কথা ছিল। কিন্তু কোনো কিছুই অদ্যাবধি সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাসমূহের নিদ্রাভঙ্গ করিতে পারে নাই, যাহা পূর্বেই উল্লেখ করা হইয়াছে।

তবে ঢাকার বায়ুদূষণ বিষয়ে উচ্চ আদালত যেভাবে ধারাবাহিক সক্রিয়তা প্রদর্শন করিতেছেন, উহা অব্যাহত থাকিলে পরিস্থিতির উন্নতি ঘটিবে বলিয়া আমাদের প্রত্যয়। প্রতিবেদন অনুসারে, আগামী ২২ ফেব্রুয়ারি জনস্বার্থসংশ্নিষ্ট মামলার পরবর্তী শুনানি অনুষ্ঠিত হইবে। আমাদের প্রত্যাশা, উক্ত ৯ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়িত না হইলে সংশ্নিষ্ট সরকারি সংস্থাকে তলবপূর্বক ব্যাখ্যা চাহিবার যে হুঁশিয়ারি রবিবার আদালত দিয়াছেন, তাহা গুরুত্বপূর্ণ বলিয়াও আমরা মনে করি। স্মরণযোগ্য, বিশ্বে সর্বোচ্চ মৃত্যুঝুঁকি তৈরির কারণসমূহের তালিকায় বাযূদূষণের অবস্থান পঞ্চম স্থানে এবং ২০১৯ সালের স্টেট অব গ্লোবাল এয়ার রিপোর্ট অনুসারে, ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ১ লক্ষ ২৩ সহস্র মানুষ বায়ুদূষণজনিত রোগে মৃত্যুবরণ করিয়াছে। উপরন্তু বিজ্ঞান সাময়িকী ল্যানসেটের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, পরিবেশদূষণের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশের দুই লক্ষসহ বিশ্বে ৯০ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে।

বিষয় : সম্পাদকীয় নিদ্রামগ্ন

মন্তব্য করুন