নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনীতিতে জোট-মহাজোটের চিত্র-প্রতিচিত্র দেখা যায়। এসব জোট-মহাজোটের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক উদ্দেশ্য থাকে। তাত্ত্বিক উদ্দেশ্য হচ্ছে, জোটের ব্যানারে সংখ্যার পরিবৃদ্ধি; অন্যদিকে প্রায়োগিক হলো, ভোটের রাজনীতিতে দেশব্যাপী অসংখ্য মানুষের সমর্থন। সমসাময়িক রাজনৈতিক অঙ্গনে যেসব জোটের খবর পাওয়া যাচ্ছে, মনে হয় তারা তাত্ত্বিক দিকটিকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। প্রায়োগিক দিকে তাদের নজর কম। যেসব রাজনৈতিক দলের নাম শোনা যাচ্ছে, এর অনেকগুলোর নিবন্ধন নেই। আবার যেগুলোর নিবন্ধন রয়েছে সেগুলোর জনসমর্থন নেই। এমনও হতে পারে, বিদেশি কূটনৈতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে জোটে ভেড়ানো হচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। এ ছাড়া শতাধিক দলের নাম আছে রাজনীতির মাঠে। এর মধ্যে বেশিরভাগই নামসর্বস্ব, ব্যক্তিনির্ভর। সারাবছর শীতনিদ্রায় থাকলেও নির্বাচনী মৌসুমে এ দলগুলোর তৎপরতা বেড়ে যায়।

রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের যে নিয়ম সচরাচর দেখা যায়, তার মধ্যে অন্যতম- নির্দিষ্ট একটি জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে তাদের বিপদ-আপদে পাশে থাকা; বিভিন্ন প্রয়োজনে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করা; অনিয়মের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে সবার নজর কাড়া; প্রাকৃতিক দুর্যোগ কিংবা দুর্বিপাকে দুর্দশাগ্রস্তদের পাশে থাকার তাগিদ অনুভব করা; সর্বোপরি জনগণের কাতারে মিশে গিয়ে তাদের সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করার মানসিকতাসম্পন্ন ব্যক্তিই জনপ্রতিনিধি হিসেবে আবির্ভূত হন এবং অনুরূপ ঘটনা পরম্পরায় একটি রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটে। রাজনৈতিক দল ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের জনসমর্থনের বিষয়টি একটি অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে যেসব রাজনৈতিক নেতা তথা দলের বিষয়ে খবর শোনা যায়, সারাদেশে তাদের জনসমর্থন নেই বললেই চলে। এসব রাজনৈতিক দল সম্পর্কে সাধারণ মানুষ খুব একটা অবগত নয়। কিন্তু নির্বাচন সামনে রেখে জোটের সংখ্যাগত বিচারে এ দলগুলো যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করে।

উপমহাদেশের রাজনীতিতে জোটের প্রবণতা অনেক পুরোনো। স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশেও রাজনৈতিক জোটের নমুনা দেখা গেছে এবং নির্বাচন সামনে রেখে এ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গঠনের মাত্র সাত বছরের মাথায় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের ভিত কাঁপিয়ে দিয়েছিল তখনকার বিরোধী দলগুলো। স্বাধীন বাংলাদেশেও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ১৫ দল এবং বিএনপির নেতৃত্বে সাত দল মাঠে ছিল। অর্থাৎ রাজনীতিতে জোটের গুরুত্ব আগেও ছিল এবং এখনও রয়েছে। পরে অবশ্য ১৫ দল ভেঙে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আটদলীয় জোট হয়েছিল। আর বাম দলগুলো মিলে পাঁচদলীয় জোট করেছিল। দলগুলোর আন্দোলনের কারণেই পতন ঘটেছিল স্বৈরাচারী সরকারের।

নির্বাচন সামনে রেখে রাজনীতির মাঠে বিভিন্ন খেলা শুরু হয়েছে। চলছে নানা মেরূকরণ। ১৪ দল থাকলেও টানা তৃতীয় মেয়াদের সরকারে আওয়ামী লীগ ব্যতীত বাকিদের সে অর্থে অংশগ্রহণ নেই। এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টিতে চলছে মেরূকরণ, কোন্দল। দলটির কাউন্সিলকে কেন্দ্র করে শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরোধ ও দ্বন্দ্বের খবর চাউর হলেও আপাতত জাতীয় পার্টির রাজনীতি কিছুটা হলেও স্থিতিশীল বলা চলে। রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের মধ্যে সম্পর্কের টানাপোড়েন চললেও বর্তমানে তা স্বাভাবিক। ভোটের হিসাবে জাতীয় পার্টির সারাদেশে একটি গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। সংগত কারণেই জাতীয় পার্টিকে আওয়ামী লীগ সঙ্গে রাখতে চাইবে। তবে ইদানীং ১৪ দলও আওয়ামী লীগের কাছে বেশ গুরুত্ব পাচ্ছে। খবরে জানা যায়, নির্বাচন সামনে রেখে বেশ কিছু ইসলামী দলের সঙ্গেও আওয়ামী লীগ সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদেরসহ শীর্ষ নেতারা সরকারবিরোধী আন্দোলনের কথা বলছেন। আবার অনেকেই বলছেন জাতীয় পার্টি আর যা-ই করুক শেষমেশ জোট বাঁধলে আওয়ামী লীগের সঙ্গেই বাঁধবে। বিএনপিও বলে দিয়েছে, একমাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া আর সব দলের জন্য তাদের দরজা খোলা। তাদের যুগপৎ আন্দোলনে সবাই অংশ নিতে পারবে। বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্সের বক্তব্যে স্পষ্ট, প্রথম দফায় তাঁরা যে ৩৫টি দলের সঙ্গে সংলাপ করেছেন, এবারও তাদের সঙ্গেই সংলাপ হচ্ছে। তার ভাষায়, দ্বিতীয় দফা সংলাপের মূল উদ্দেশ্য যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা চূড়ান্ত করা। আমরা এরই মধ্যে এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়, সে ব্যাপারে একমত হয়েছি। তবে অনেকেই মনে করেন, নির্বাচনের মাঠে জামায়াতই বিএনপির সবচেয়ে বড় শক্তি আবার বিএনপি অন্তঃপ্রাণ তৃণমূলকর্মীরা জামায়াতকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে পারেননি। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এই জামায়াতই আবার বিএনপির সবচেয়ে বড় বোঝা, স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত ভূমিকার কারণে। বিএনপির এমন একটা অবস্থা হয়েছে- না পারে জামায়াতকে নিজের সঙ্গে রাখতে আবার না পারে ছাড়তে। সম্প্রতি বিএনপির ডাকে সাড়া দিয়ে গণমিছিলে রাজপথে ৩৩টি দল অংশ নেয়। বিএনপি দেখাতে চাচ্ছে সরকারবিরোধী সব রাজনৈতিক শক্তি বিএনপির সঙ্গে একাট্টা হয়ে আন্দোলনে সাড়া দিয়েছে। গণতন্ত্র মঞ্চ নামে সাত দলের একটি জোটও আছে যুগপৎ আন্দোলনে। আ স ম আব্দুর রব, মাহমুদুর রহমান মান্না, জোনায়েদ সাকি, নুরুল হক নুররা আছেন গণতন্ত্র মঞ্চে। সমমনা জাতীয়তাবাদী শক্তিকে নিয়ে গড়া ১১ দলীয় একটি জোটও আছে যুগপৎ আন্দোলনে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে রাজনৈতিক দলগুলো পক্ষ-বিপক্ষ নিয়ে দল ভারী করার উদ্যোগ নেয়। যাদের সঙ্গে রাজনৈতিক জোট করা হচ্ছে, এ দলের বিষয়ে সাধারণ জনগণের মতামত কিংবা দলটির জনমানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে খোঁজখবর নিয়ে জোট গঠন করা উচিত। বিশেষ করে সাম্প্রতিক সময়ে রাজনৈতিক জোটের ক্ষেত্রে যেসব রাজনৈতিক দলের নাম শোনা যাচ্ছে এবং নামসর্বস্ব এসব দলের সঙ্গে যাদের জোট গঠিত হচ্ছে, মনে হচ্ছে রাজনৈতিক মাঠে তারা দূরদর্শী নয়। জোটের সংখ্যার ভিত্তিতে জনগণ ভোট দেয় না; ভোট দেয় রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতার ভিত্তিতে। রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হবে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে। কিন্তু বর্তমানে এর ব্যতিক্রম দেখা যাচ্ছে। একটি পক্ষ মনে করছে জোটে দলের সংখ্যা বেশি হলেই জনগণের সমর্থন পাওয়া যাবে। বিষয়টি কিন্তু তা নয়। আমরা অতীতেও দেখেছি নামসর্বস্ব দলের সঙ্গে জোট করে ভোটের রাজনীতিতে সফলতা আনা সম্ভব হয়নি। জোট গঠন করতে হবে জনগণের কাছে যেসব দলের গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে সেসব দলের সমন্বয়ে। না হলে ভোটের রাজনীতিতে ফল ইতিবাচক না হয়ে নেতিবাচক হওয়ার আশঙ্কাই বেশি।