
হতে পারেন তিনি একজন বিরোধী দলের কর্মী। কিন্তু তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা, যাঁদের নামের আগে আমরা সম্মানসূচক 'বীর' শব্দটা ব্যবহার করে থাকি। বয়সও ষাটের কোঠা ছাড়িয়ে সত্তুরে ছুঁয়েছে। এই মানুষটিকে হাতকড়া আর কোমরে রশি বেঁধে আদালতে তোলা হয়েছে। অপরাধ, বর্তমান সময়ে বহুল ব্যবহূত শব্দ সেই 'নাশকতা'। এটা প্রমাণে কথিত অপরাধীর রাজনৈতিক পরিচয়ই যথেষ্ট। বলছি নরসিংদীর শিবপুর উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু ছালেক রিকাবদারের কথা। গত ১১ ফেব্রুয়ারি তাঁকে কোমরে রশি বেঁধে আদালতে হাজির করা হয়। আগের দিন তাঁকে তাঁর বাড়ির সামনে থেকে গ্রেপ্তার করে শিবপুর থানা পুলিশ। আদালত তাঁর জামিন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠান। (সমকাল, ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৩)। যদিও পরবর্তী সময়ে উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ এবং আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতিসহ অনেকেই এ ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন। কেবল নিন্দা জানানোর মধ্য দিয়ে এটিকে শেষ করে দিলে জাতির জন্য তা হয়ে থাকবে এক অমোচনীয় কলঙ্কের সাক্ষী।
যেদিন এই বীর মুক্তিযোদ্ধার কোমরে রশি বেঁধে আদালতে নেওয়ার ছবি প্রকাশিত হলো, সেদিনই দেশের সবক'টি জাতীয় দৈনিকে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে আরও একটি খবর ছাপা হয়েছে। গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত অসচ্ছল মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য নির্মিত আবাসন প্রকল্পের হস্তান্তর কার্যক্রম উদ্বোধন করতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বীর মুক্তিযোদ্ধা ভিক্ষা করবে, রিকশা চালাবে এটা হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী এ দেশের কোটি মানুষের মনের কথা এতে কোনো সন্দেহ নেই। প্রশ্ন হলো সুন্দর আবাসন আর পেটে ভাতের সঙ্গে যদি কোমরে রশি বাঁধা থাকে তাহলে সেই আবাসন কি একজন মুক্তিযোদ্ধার সম্মান নিশ্চিত করতে পারে?
আমি নিশ্চিত এ ঘটনাটি যদি সরকারদলীয় কারও সঙ্গে ঘটত তাহলে এতক্ষণে একে স্বাধীনতাবিরোধীদের ষড়যন্ত্র বলে তোলপাড় শুরু হয়ে যেত। বিবেচ্য ক্ষেত্রে এর কোনো সুযোগ নেই। কারণ, বর্তমান সময়ে উপজেলা বা থানা পর্যায়ে যেসব পুলিশ সদস্য কর্মরত আছেন তাদের প্রায় সবারই নিয়োগ হয়েছে আওয়ামী লীগের আমলেই। সে ক্ষেত্রে ধরেই নেওয়া যেতে পারে যে, যে পুলিশ সদস্যটি একজন মুক্তিযোদ্ধার কোমরে রশি বেঁধেছেন তিনিও আওয়ামী আমলেরই নিয়োগপ্রাপ্ত এবং স্বাধীনতাবিরোধী পক্ষের কেউ নন। তাহলে এমনটি কেন হলো? জবাব একটাই- কথিত অপরাধী বিরোধীদলীয় কর্মী বা সমর্থক। তাই তাঁর ক্ষেত্রে চেতনার মানদণ্ডও ভিন্ন। বিরোধী দলের কেউ যদি মুক্তিযোদ্ধাও হন, তাঁর ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা প্রযোজ্য নয়।
তাইতো দেখি সরকারি দলের কেউ যদি কোনো অপরাধ করে তাহলে সে থানার ওসির সঙ্গে বসে খানাপিনা করলেও পুলিশ তাঁকে খুঁজে পায় না। এমনই এক খবর বেরিয়েছিল গত বছর মার্চ মাসে কক্সবাজারের চকরিয়া থানার ওসির বিরুদ্ধে। খবর মতে, এক হত্যাচেষ্টা মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামিকে নিয়ে তিনি কেক কেটে নিজের জন্মদিন উদযাপন করেছিলেন। অথচ পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হচ্ছিল যে, আসামিকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। (চ্যানেল টোয়েন্টিফোর, ১৭ মার্চ, ২০২২)। এমনতর ঘটনার ভূরি ভূরি উদাহরণ দেওয়া যাবে, যেখানে আসামি পুলিশের নাকের ডগা দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। অথচ পুলিশ তাদের ধরছে না। বলাবাহুল্য এসবই সরকারদলীয় বা দলীয় সমর্থকদের বেলাতে প্রযোজ্য, বিরোধীদের বেলায় নয়। বিরোধীদলীয় কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ উঠলে তাঁকে না পেলে তাঁর পরিবারের নিরপরাধ সদস্যদের পর্যন্ত থানায় ধরে নিয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে।
আমি বলছি না- একজন মুক্তিযোদ্ধা যদি কোনো অপরাধ করে তাহলে তাঁর বিচার হবে না। বিচার অবশ্যই হবে এবং হতে হবে। কিন্তু কারও বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বিচার শুরু হওয়ার আগেই যদি তাঁকে কোমরে রশি বেঁধে ঘোরানো হয়, তাহলে জাতির কাছে তা মুক্তিযোদ্ধাদের সম্পর্কে কী বার্তা দেবে? একজন মুক্তিযোদ্ধার কোমরে রশি বাঁধার আগে আমাদের নীতিনির্ধারকদের বিষয়টি একবার ভেবে দেখা দরকার ছিল।
এ ক্ষেত্রে আরও একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য। তা হলো- সবাই জানি বর্তমানে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযোদ্ধাদের কল্যাণে অনেক পদক্ষেপ নিয়েছে। তাদের ভাতা বাড়ানো হয়েছে, আবাসনের ব্যবস্থা করা হয়েছে, তাদের সন্তানদের চাকরির জন্য কোটা করে দেওয়া হয়েছে- এমন আরও অনেক আছে। মাত্র একজনের কোমরের রশি যে সরকারের সব ভালো কাজকে ম্লান করে দিয়েছে- এ কথা কি তারা বুঝতে পারছেন?
আমি বিশ্বাস করতে চাই- এই যে একজন পুলিশ সদস্য একজন মুক্তিযোদ্ধার কোমরে রশি বেঁধেছে, তার নির্দেশ সরকারের ঊর্ধ্বতন কোনো কর্মকর্তার কাছ থেকে আসেনি। হতে পারে সে অতিউৎসাহী হয়েই কাজটি করেছে। বর্তমানে আমাদের প্রশাসনে এ রকম অনেক অতিউৎসাহী রয়েছে, যারা তাদের অপকর্ম ঢাকা কিংবা ভালো পোস্টিং বা চাকরিতে বাড়তি সুযোগসুবিধা পাওয়ার আশায় রাজনৈতিক কর্মীর মতো আচরণ করছে। অন্যদিকে সরকারও ক্ষমতা টিকিয়ে রাখাসহ নানাবিধ বোধগম্য কারণে এই অতিউৎসাহীদের কর্মকাণ্ডকে নীরবে মেনে নিচ্ছে। এতে করে আখেরে যে সরকারেরই ক্ষতি হচ্ছে, তা তারা বুঝতে পারছে না।
যাক, কল্পকাহিনির রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের এক কাহিনি দিয়েই লেখাটা শেষ করতে চাই। রাজা কৃষ্ণচন্দ্র একবার পেয়াদাকে ডেকে বললেন, ওহে ভজহরি ব্যাপারীকে একবার ডেকে আনবি তো। পেয়াদা ব্যাপারীকে একেবারে দড়ি দিয়ে বেঁধে রাজসভায় হাজির করল। এদিকে ভজহরির ওপর নানা কারণে রাজসভার ভাঁড় গোপাল খুব চটে ছিল। তাই পেয়াদা তাকে রাজসভায় বেঁধে এনেছে দেখে গোপাল খুব খুশি হলো। রাজা কিন্তু পেয়াদার ওপর চটে গিয়ে বললেন, আমি ভজহরিকে ডেকে আনতে বললুম, আর তুই কিনা একেবারে বেঁধে নিয়ে এলি? তোকে আমি বরখাস্ত করব। পেয়াদা কাঁদতে কাঁদতে বলল, আর করব না হুজুর। এবারের মতো বেয়াদপি মাপ করুন।
গোপাল পেয়াদার পক্ষ নিয়ে ওকালতি করে মোলায়েম স্বরে বললে, হুজুর একে বরখাস্ত করবেন না- এ হচ্ছে জাত পেয়াদা। পেয়াদারা ধরে আনতে বললে বেঁধেই আনে। যদি জাত পেয়াদা না হতো সে কখনোই বেঁধে আনত না। কথাটা ঠিক কিনা এবার মহারাজ আপনি বিবেচনা করে দেখুন। গোপালের কথায় রাজা হেসে ফেললেন এবং অতি করিৎকর্মা পেয়াদাকে ক্ষমা করে দিলেন সেবারের মতো। আমাদের প্রশাসনেও এমন অনেক পেয়াদা রয়েছে। আরও রয়েছে রক্ষাকর্তা গোপাল ভাঁড়। এদের ব্যাপারে সতর্ক না হলে সরকারের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না কখনও।
মোশতাক আহমেদ: কলাম লেখক; জাতিসংঘের সাবেক কর্মকর্তা
মন্তব্য করুন