- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- রাষ্ট্রভাষা বলতে যা বোঝায় বাংলা তা হয়নি
মাতৃভাষা দিবস
রাষ্ট্রভাষা বলতে যা বোঝায় বাংলা তা হয়নি

বাংলা ভাষা প্রকৃতই এখন মধ্যবিত্তের সেই অংশের মানসিক সম্পদ, যে অংশ রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে দূরে। আর এদের মধ্যেও যে সুপ্ত আকাঙ্ক্ষা নেই ইংরেজি শিখবার, তাও বলা যাবে না। পারলে শিখত। পারে না, তাই শেখে না। সেই ইংরেজ যুগের অবস্থা। সে যুগে বাঙালি মুসলমান ইংরেজি শেখেনি। প্রচার করা হয়েছিল- রাজ্য হারানোর গভীর অভিমানে বাঙালি মুসলমান নাকি ইংরেজি ভাষা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল; খুব দৃঢ়ভাবে। অথচ আসল খবর এই- রাজ্য না ছিল বাঙালির, না ছিল বাঙালি মুসলমানের। রাজ্য ছিল অবাঙালিদের হাতেই। যার অমাত্য ও বড় আমলা অধিকাংশই ছিল অবাঙালি। বাঙালি মুসলমানের ইংরেজি না শেখার প্রকৃত কারণ অর্থনৈতিক। তারা বড়ই গরিব ছিল। এ যুগে সে যে ইংরেজি শিখতে পারছে না, তার জন্যও একই দুর্বলতা দায়ী। যারা সম্পত্তির মালিক হতে পেরেছে তারা তো আর দেরি করছে না। ভীষণ বেগে ইংরেজি শিখছে।
যেন এতদিন না শেখার প্রায়শ্চিত্ত। ধর্মীয় প্রায়শ্চিত্তের তুলনায় ইহজাগতিক প্রায়শ্চিত্ত যে প্রবল- তা প্রমাণিত হচ্ছে বুঝি।
কথাটা এখানে পরিস্কার করে নেওয়া দরকার। বায়ান্নতে পূর্ববঙ্গের মধ্যবিত্ত, যারা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন করেছে তারা অবশ্যই উর্দুবিরোধী ছিল। সেটা নিয়ে তো কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু তারা কি ইংরেজিবিরোধী ছিল?
এই জিজ্ঞাসার উত্তরে আমরা যে প্রবল বেগে 'না' বলব, সেটা সম্ভব নয়। মধ্যবিত্ত বাঙালি ইংরেজিকে অপছন্দ করত না।
প্রথমত, ততদিনে তারা ইংরেজি খানিকটা রপ্ত করে ফেলেছে। আরও করতে যে তাদের অধিক আপত্তি ছিল, তা নয়। দ্বিতীয়ত, তাদের মনের ভেতর ওই ধরনের একটা ধারণাও ক্রিয়াশীল ছিল- ইংরেজি জানলে চৌকস, চটপটে, দক্ষ সর্বোপরি আন্তর্জাতিক হওয়া সম্ভব। এসব তারা হতে চাইছিল বৈকি। ঘটনাক্রমে পুঁজিবাদের প্রধান ভাষা হচ্ছে ইংরেজি এবং বাঙালি মধ্যবিত্তের সামনে উন্নতির জন্য অন্য কোনো পথ কখনোই দেখা দেয়নি, যেটা পুঁজিবাদী নয়। পাকিস্তানের জন্ম হওয়ার আগে মুসলমান মধ্যবিত্তের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল হিন্দু মধ্যবিত্ত; ইংরেজি শিক্ষার ক্ষেত্রে যারা অন্তত ৫০ বছর এগিয়ে ছিল। সেই প্রতিদ্বন্দ্বী অপসারিত হলে মুসলমান মধ্যবিত্তের সুবিধা হবে- এটাই ছিল আশা। কিন্তু উর্দুওয়ালারা তাদের ভাষার জোরে সুবিধা লাভের ওই আশাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, এমন আশঙ্কা যখন দেখা দিল তখন তারা স্বভাবতই যেমন হতাশ তেমন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছিল। সেখান থেকেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত, যদিও এ আন্দোলনের তাৎপর্য, গভীরতা ও ফলশ্রুতি নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করা পর্যন্ত প্রসারিত হয়ে গেছে।
স্বাধীনতার পর এই শ্রেণিরই ধনী হয়ে ওঠা অংশ শাসক শ্রেণিতে পরিণত হয়েছে এবং নিজেদের উন্নতির জন্য পুঁজিবাদী পথ ধরেছে। পুঁজিবাদের টানটাই তাদের মাতৃভাষার প্রতি বিমুখ করে তুলেছে। তারা একদিকে জনগণ থেকে দূরবর্তী, অন্যদিকে পুঁজিবাদের নিকটবর্তী হতে চায়। যে জন্য ইংরেজি ভাষা তাদের আকর্ষণ করে। হাজার হোক, বাংলা স্থানীয় ভাষা বটে এবং তাদের দৃষ্টিতে এ ভাষা গ্রাম্যও বৈকি। শাসক শ্রেণি যা করে সেটাই তো আদর্শ। সেই আদর্শই সমাজের অন্যত্র
ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে বাংলা ভাষার অমর্যাদা ঘটেছে এবং ঘটছে।
ইংরেজ আমলে রাষ্ট্র ছিল ঔপনিবেশিক ও আমলাতান্ত্রিক। পাকিস্তানিরাও একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা সেটিকে স্থাপন করেছিল ধর্মের ওপর। উর্দুকে তারা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চাইল; অথচ উর্দু পাকিস্তানের অধিকাংশ নাগরিকের ভাষা তো ছিলই না, কোনো অঞ্চলেরও ভাষা ছিল না। উর্দুর পক্ষে যুক্তিটা ছিল সামন্তবাদী। সেটা হলো এই- উর্দু ধর্মীয় ভাষা, আরবির কাছাকাছি। বিপরীত দিকে তাদের মতে, বাংলা ছিল পৌত্তলিক ভাষা। বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা যে বাংলা নয়, সেটা যে উর্দু- এই প্রচার পাকিস্তান হওয়ার আগেও করা হয়েছে। অনেকটা যেন তারই সূত্র ধরে পাকিস্তান আমলে বলা শুরু হলো, বাংলা ভাষার বর্ণমালা যেহেতু দেবনাগরীর কাছাকাছি, তাই তাকে বদলে আরবি হরফে লেখা দরকার। রবীন্দ্রনাথকে বাদ দাও; নজরুলকে সংশোধিত করো। কিছু কিছু শব্দ বড় বেশি হিন্দু; তাদেরকে মুসলমান করো- এসব উপদেশ দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু পূর্ববঙ্গ রুখে দাঁড়াল। ফলে অন্তত এই রণাঙ্গনে সামন্তবাদী শক্তি পরাভূত।
তা এখানে সে আপাতত পরাভূত হয়েছে বৈকি। এখন আর রাষ্ট্রভাষা উর্দু চাই- এ দাবি ঘোরতর মৌলবাদীরাও করবে না। বরং এখন দেখা যাচ্ছে, মৌলবাদীরা বলার চেষ্টা করছে, ভাষা আন্দোলনে তারাও ছিল। আন্দোলনের সূত্রপাত নাকি তারাই ঘটিয়েছে। এখন নাকি ইতিহাস বিকৃত করে তাদের অস্বীকার করা হচ্ছে। বীজটি যখন বপন করা হচ্ছিল, তখন কাছে ছিল। হয়তো মাটিও দু'এক মুঠো ফেলেছে আশপাশে। তাই বৃক্ষটি তাদেরই সম্পত্তি- এই তাদের দাবি। দাবিটি যেমনই হোক, তারা যে বৃক্ষটিকে মূল্যবান বলে স্বীকার করছে; তাকে কাটতে চাইছে না; অতীতে যেমন চেয়েছিল- সেটাই অধিক তাৎপর্যপূর্ণ।
বাংলা রাষ্ট্রের ভাষা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্রের ভাষা বলতে যা বোঝায়, তা হয়নি। উচ্চ আদালতে বাংলা এখনও অপ্রচলিত, আগে যেমনটা ছিল। উচ্চশিক্ষাতেও বাংলা ব্যবহূত হচ্ছে না। আমলাতন্ত্রের উঁচুমহলে বাংলার ব্যবহারকে উৎসাহিত করা হয় না। উচ্চবিত্তদের মুখের ভাষায় ইংরেজি শব্দ, বাক্যাংশ, এমনকি আস্ত আস্ত বাক্যে বাংলা শব্দ বিড়ম্বিত, এমনকি পর্যুদস্ত হতে থাকে। বিজ্ঞ ও প্রাজ্ঞ গবেষণা বাংলায় না পাওয়া- এটাকেও তো বিশ্বাস করা সহজ নয়। কিন্তু করতে হচ্ছে। আর যতই অবিশ্বাস্য বলি, এটা ঘটেছে এবং ঘটার কারণও রয়েছে। সেই কারণ কিন্তু জনগণ নয়; শাসক শ্রেণি। বাংলা কখনোই শাসক শ্রেণির ভাষা ছিল না। ভাষা ছিল সে খেটে খাওয়া মানুষের। শাসকরা সংস্কৃত, ফার্সি, ইংরেজি- এসব ভাষা ব্যবহার করেছে। আর খেটে খাওয়া মানুষ ব্যবহার করেছে যেটা, তাদের মাতৃভাষা সেই বাংলাকে। একাত্তরে স্বাধীনতার পরও আমরা দেখছি একই রকম ঘটনা; বাংলা শাসক শ্রেণির কাছে সেই মর্যাদা পাচ্ছে না, যেটি প্রত্যাশিত ছিল, যদিও জাতিগত পরিচয়ে এই নতুন শাসকরা আগের কালের শাসকদের মতো অবাঙালি নয়; বাঙালিই বটে।
আজ আমরা স্বপ্ন দেখি- বাংলা সব বাঙালির ভাষা হবে। এই ভাষার ব্যবহার ও চর্চার মধ্য দিয়ে সারাবিশ্ব এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রে বসবাসকারী ৩০-৩২ কোটি বাঙালি নিজেদের মধ্যে আত্মীয়তা গড়ে তুলবে, মর্যাদাবান হবে। সমৃদ্ধ হয়ে উঠবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে। এ কোনো অলীক স্বপ্ন নয়। কেননা, এর বাস্তবায়ন খুবই সম্ভব। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের দায়িত্ব নিতে হবে বাংলাদেশের বাঙালিকেই। বাংলাদেশই হচ্ছে বাংলা ভাষার প্রধান ঘাঁটি। এখানে ভালো যা ঘটবে তার সুফল পাওয়া যাবে অন্যত্র এবং সর্বত্র। এক কথায় বলতে গেলে বাংলাদেশের সর্বক্ষেত্রে এবং ক্রমবর্ধমান হারে আমরা বাংলা ভাষার প্রচলন চাই।
সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন