
নতুন করে বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির খবর আমরা জানতে পারলাম। এবার দেখা গেল খুচরা পর্যায়ে ৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করা হয়েছে। গত তিন মাস ধরে দেখা যাচ্ছে, প্রতি মাসেই দাম বাড়ানো হয়েছে। আগে বিইআরসির মাধ্যমে দাম বাড়ানো হতো। এখন হচ্ছে সরাসরি নির্বাহী আদেশে। এতে ভোক্তার অধিকার বা স্বার্থ রক্ষার সর্বশেষ সুযোগটিও বন্ধ হয়ে গেল। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সমন্বয় করতে গিয়েই দাম বাড়ানো হয়েছে। কিন্তু কতখানি সমন্বয় হচ্ছে, জনসাধারণ জানতে পারে না। এর ওপর দফায় দফায় মূল্যবৃদ্ধি জনসাধারণের জন্য বোঝার ওপর শাকের আঁটি ছাড়া কিছু নয়। এই শাকের আঁটি নামাতে হবে; বোঝাও কমাতে হবে।
আমরা দেখতে পাচ্ছি গত ১৪ বছরে পাইকারি পর্যায়ে ১১ বার এবং ভোক্তা বা সাধারণের পর্যায়ে ১৩ বার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে সরকার উন্নয়নের কথা বলে থাকে। কিন্তু তা জনসাধারণের ওপর যে কতখানি চাপ তৈরি করছে, মোটেই আমলে নেওয়া হয় না। এভাবে বিদ্যুতের দাম বাড়ানো ফলে নিত্যপণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুর দাম বাড়তি। মানুষের ভোগান্তি ক্রমেই বাড়ছে। বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের ভুল সিদ্ধান্তের অসহায় খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের মানুষকে।
দেশে আগামীতে বিদ্যুৎ নিয়ে বড় ধরনের সংকট তৈরি হবে– এমন আলোচনা শোনা যাচ্ছে। কিন্তু এমন আলোচনা করার মানে, বর্তমানে যে সমস্যা রয়েছে সেগুলোকে আড়াল করা।
দেশে বিদ্যুৎ নিয়ে সংকট মূলত শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশক থেকে। এর পর ২০০৫-২০০৬ সালের দিকে মাইলের পর মাইল বিতরণ লাইন বসানো হয়েছিল; কিন্তু তাতে বিদ্যুৎ ছিল না। তারপর ২০২০ সাল নাগাদ ঘরে ঘরে বিদ্যুতের লাইন সঞ্চালন করা হলো। কিন্তু সেই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য জ্বালানির ব্যবস্থা করা যাচ্ছে না। তার মানে, বিদ্যুৎ নিয়ে সমস্যা থেকেই গেল।
একটা সময়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য প্রয়োজনীয় মেশিন ছিল না। এখন মেশিন আছে কিন্তু জ্বালানির অভাবে উৎপাদন করতে পারছি না। আমাদের নিজস্ব জ্বালানি গ্যাস ও কয়লা উত্তোলন করিনি। আমরা এক সময় গ্যাস দিয়ে, কয়লা দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপন্ন করার মেশিন জোগাড় করতে পারিনি। তাই বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ ছিল। আবার এখন মেশিন হয়েছে কিন্তু গ্যাস ও কয়লা নেই! আমরা এলএনজি আমদানি করা শুরু করলাম। বলা হলো, আমদানি করা এলএনজি দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হবে। কিন্তু তাতে আমদানি ব্যয়ের সঙ্গে মূল্য বৃদ্ধি করেও সমন্বয় করতে পারিনি। ২০২০ সালে আমরা ৩৬০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিয়ে বিদ্যুতের মূল্য বৃদ্ধি করে একটি ব্যালান্স পজিশনে এলাম। এরপর করোনা মহামারি চলে এলো। সেই সময়ে ভালোভাবেই চলতে থাকল। করোনা পরিস্থিতির এক সময়ে উন্নতি হলো। তার ঠিক পরই ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরু হওয়ার ফলে একটি নতুন মাত্রা যোগ হলো– জ্বালানি সংকট।
সামনে গ্রীষ্মের মৌসুমে লোডশেডিংয়ে সারাদেশের গ্রাহকের ভোগান্তি হওয়ার একটি আশঙ্কা এখনই তৈরি হচ্ছে। এটা গত বছরের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি হয়েছে। গত বছর সরকারপ্রধানও বলেছিলেন লোডশেডিংয়ের সময় আগেই জানিয়ে দিতে। কিন্তু আমরা লোডশেডিংয়ের কোনো পরিল্পনা কি পেয়েছি? জ্বালানি উপদেষ্টা বলেছেন পরিকল্পিত লোডশেডিংয়ের কথা। কিন্তু এখনও পরিপূর্ণ পরিকল্পনা দেখতে পাচ্ছি না। যেভাবে সমস্যার কথা ওপরের দিক থেকে শোনা যাচ্ছে; সমাধানের কথা সেভাবে শোনা যাচ্ছে না। লোডশেডিং কেন হচ্ছে? জ্বালানি সংকটের জন্য। এখন জ্বালানি সংকটের জন্য বিদ্যুতের ঘাটতির কথা বলা হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য মূল্য বৃদ্ধি করা হলো। তার মানে একটা দুষ্টচক্রের মধ্যে আমরা পড়ে গেছি। কেন পড়ে গেছি, এর কোনো সদুত্তর নেই।
বর্তমানে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হচ্ছে, তার জন্য সঞ্চালন লাইনে ঘাটতি নেই। প্রক্ষেপণ অনুসারে বিদ্যুতের চাহিদা বাড়েনি; বিশেষ করে শিল্প খাতে। এটিও আমাদের জন্য অশনিসংকেত। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের নিশ্চয়তা না থাকায় এসব খাতের বড় অংশ নিজস্ব উৎপাদিত বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীল রয়ে গেছে। তাই জাতীয় গ্রিডে চাহিদা বাড়েনি। তবে উৎপাদন বৃদ্ধির সঙ্গে সঞ্চালন লাইন বাড়ানোর পরিল্পনা ছিল। এখন আর সেসব কথা হচ্ছে না।
মনে রাখতে হবে, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা খোলাচোখে দেখা যাবে না। খাদ্য সংকট হলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয়। আর বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের কারণে খাদ্যসহ অন্যান্য উৎপাদন সংকট দেখা দেয়। সমাজের সুবিধাবাদীদের যেমন দুর্ভিক্ষ স্পর্শ করে না; তেমনি বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটের তীব্রতা বিত্তবানদের স্পর্শ করে না। খাদ্যের অভাবে যেমন প্রান্তিক মানুষ কষ্ট পায়, তেমনি বিদ্যুৎ সংকটের কারণে তারাই নানামুখী কষ্ট পাচ্ছে। দুর্ভিক্ষ হলে যেমন খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহে গুরুত্ব দিতে হয়, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সংকটকে তার চেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার। কারণ, বিদ্যুৎ সংকট দেশের অর্থনীতিকে ভেতর থেকে পঙ্গু করে দেয়। কিন্তু খালি চোখে তা দেখা যায় না।
কেউ স্বীকার করুক বা না করুক, বাস্তবতা হচ্ছে– সরকারের অতিরিক্ত আমদানি-নির্ভরতা। আর বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে অপচয়-দুর্নীতি রোধ না করার কারণেই পরিস্থিতি এত সংকটপূর্ণ হয়ে উঠেছে। স্থানীয় জ্বালানি অনুসন্ধান কার্যক্রম ব্যাপকভাবে জোরদার করার জন্য গত এক যুগে সরকারের হাতে যথেষ্ট সময় ছিল। অনুসন্ধানের মাধ্যমে জ্বালানির স্থানীয় মজুত বাড়ানো গেলে এখনকার সংকটে পড়তে হতো না। বিশ্ববাজারে যখন দীর্ঘদিন তেলের দাম কম ছিল, তার সুবিধা জনগণ পায়নি। এখন দাম বেড়ে যাওয়ায় আমদানি কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। সত্যিকার অর্থে জ্বালানিতে সরকারের ভুল নীতি ও কাজের খেসারত দিতে হচ্ছে জনগণকে। এখন দেশে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জনসাধারণকে কষ্টে রেখে এ উন্নয়ন আসলে অন্তঃসারশূন্য।
জনসাধারণ আর্থিক সংকটে আছে; প্রতিষ্ঠানগুলো পড়েছে আর্থিক টানাপোড়েনে। সরকার তার ব্যয় কমাতে নানা পদক্ষেপের কথা বলছে। এসব করতে গিয়ে মানুষ বেঁচে থাকার তাগিদে তাদের ভোগব্যয় কমিয়ে আনছে। বিলাসিতা থেকে নিজেদের বঞ্চিত করছে। যদি বিদ্যুতের জন্য এখনই কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া না হয়; বিশেষ করে সরকারের সব পর্যায়ের অংশীজন যদি সমন্বিতভাবে কোনো কর্মসূচি গ্রহণ না করে; তাহলে এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। এভাবে দীর্ঘদিন চললে জনসাধারণের জীবনমান, অধিকার– সবই লুণ্ঠিত হয়ে যাবে।
অধ্যাপক এম শামসুল আলম: জ্বালানি বিশেষজ্ঞ
মন্তব্য করুন