সানোয়ার হোসেন আর নেই– এই বেদনাবিধুর খবর যখন পেলাম তখন বিশ্বাসই হচ্ছিল না, অমন তরতাজা দিলখোলা হাসির প্রাণবন্ত প্রকৃতিপ্রেমী মানুষটি তার লড়াকু জীবনের ইনিংসের ইতি টেনেছে।

‘বাংলাদেশ পউস’-এর সানোয়ারের সঙ্গে আর কোনো দিন দেখা হবে না, কথা হবে না– ভাবতেই বুকে মোচড় দিয়ে ওঠে। ‘কামরুল ভাই, কেমন আছেন? আমার অনুষ্ঠানে আপনাকে আসতেই হবে’– দরাজ কণ্ঠে এমন অধিকার নিয়ে খুব কম জনই আমাকে তার মতো করে আমন্ত্রণ জানাত।

সানোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়জীবন শেষ করে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে পরিবেশবিদ ড. হারুনুর রশীদের হাত ধরে পউসে যোগ দেয়। বাংলাদেশ পউস এ দেশে সবচেয়ে পুরোনো পরিবেশ সংরক্ষণবাদী সংগঠনের পহেলা কাতারে ছিল। ড. হারুন ভাই তখন একই সঙ্গে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব কনজারভেশন অব নেচার-আইইউসিএন বাংলাদেশ জাতীয় কমিটির সভাপতি। পরবর্তীকালে সানোয়ারও আইইউসিএন জাতীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয় আমাদের অকুণ্ঠ সমর্থনে। প্রয়াত মাহফুজ উল্লাহ ভাই কয়েকবার আইইউসিএন রিজিওনাল কাউন্সিলর পদে দাঁড়ান। তাঁকে নির্বাচিত করার জন্য দেখেছি সানোয়ারের বিদেশি হাজারো ডেলিগেটের মাঝে দিন-রাত সে কী প্রচারণা। মাহফুজ ভাইয়ের জেতার পেছনে ওর ছিল অসামান্য অবদান।

আজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সানোয়ার ছিল নিবেদিতপ্রাণ এক লড়াকু পরিবেশ, জলাভূমি, বন সংরক্ষণবাদী। খেয়ে না-খেয়ে কাজ করেছে দেশজুড়ে। সেন্টমার্টিন থেকে সুন্দরবন, পাবনা থেকে সিলেট– সব জায়গায় ছিল ওর কার্যক্রম।

কিছু কাজে, কিছু সভায় ও আমাকে ডাকত পরম শ্রদ্ধায়, ভালোবাসার পরশে। বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম সদস্যদের সঙ্গে সানোয়ারের ছিল সখ্য। পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের আর্থিক অনটনের সময় ও ছিল আমাদের পাশে। ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবস। কয়েক বছর বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম আর পউস যৌথভাবে কারও সহায়তা ছাড়াই দিবসটি পালন করেছে। দেশি-বিদেশি বরেণ্য ব্যক্তিদের নিয়ে আলোচনা সভা করেছে।

গেল ক’বছর পউস আর্থিক অনটনে পড়ে। টানাটানিতে সানোয়ারের স্বাস্থ্য ভেঙে যায়, শরীরে বাসা বাঁধে নানা অসুখবিসুখ।

আইইউসিএন বাংলাদেশ ক’দিন আগে পালন করল ৫০ বছর পূর্তি। সানোয়ার কি সে অনুষ্ঠানের আমন্ত্রণ পেয়েছিল? ড. হারুনুর রশীদের কথা কি তারা ভুলে গেল? আমাদের কথা না-হয় বাদই দিলাম!

মন ভারী হয়ে আসে যখন ভাবি দেশ-বিদেশে আর কোনো দিন এমন সভায় আমরা একসঙ্গে বসতে পারব না। বিস্মৃতির অতলে সানোয়ার কি হারিয়ে যাবে? যেমন হারিয়ে গেছে আমাদের আরেক পরিবেশযোদ্ধা বেলার প্রতিষ্ঠাতা ড. মহিউদ্দিন ফারুক।

সানোয়ার ১৯৯৫ সালে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে। যুক্তরাষ্ট্রের হ্যারিস ইউনিভার্সিটি থেকে ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে পিএইচডি করে। সানোয়ার ১৯৯০ সাল থেকে পরিবেশের উন্নয়ন ও টেকসই সমাজ বিনির্মাণে কাজ করেছে। পরিবেশ বিষয়ক তার বেশ কয়েকটি প্রকাশনাও আছে। দেশে ও আন্তর্জাতিক জার্নালে নিবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। ২০১১-১৪ সাল পর্যন্ত সে আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণ সংঘের (আইইউসিএন) জাতীয় কমিটির নেতৃত্ব দিয়েছে। আইইউসিএনের সব কংগ্রেসে সে অংশ নেয়। ১৯৯৭ সাল থেকে সে রামসার কেন্দ্র জাপানের সদস্য।

আল্লাহ নিশ্চয়ই সানোয়ারকে বেহেশত নসিব করবেন! জলাভূমি, বন ও পরিবেশ সংরক্ষণে ও ছিল কয়েক দশকের নিরন্তর সহযোদ্ধা! শেষ ক’টা বছর কেটেছে অনটনে, অসুখবিসুখে! ওপারে ভালো থাকুক, সানোয়ার।

কামরুল ইসলাম চৌধুরী: সভাপতি, বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম