
বাংলাদেশের রূপপুরে রাশানরা যে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করছে সেটার মালপত্রবাহী জাহাজ বাংলাদেশে ভিড়তে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে রুশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মস্কোতে যিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আছেন তাঁকে তলব করা হয়েছিল। তাঁর কাছে রুশ জাহাজ ‘উরসা মেজর’কে বাংলাদেশের কোনো বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ার কারণ জানতে চাওয়া হয়েছে। শুরুতেই বলতে চাই, মস্কোতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশের যে মিশন রয়েছে, সেখানে এখন যাঁরা কর্মরত রয়েছেন, তাঁদের বিষয়টি নিয়ে আগেভাগেই তৎপর হওয়া দরকার ছিল।
যেহেতু আমেরিকা রাশিয়ার ওপর স্যাংশন বা অবরোধ দিয়েছে, তাদের পণ্যবাহী জাহাজের ওপরও এই স্যাংশন রয়েছে। তবে রাশিয়ার সব জাহাজের ওপর যেহেতু স্যাংশন দেওয়া হয়নি, তাই কোন জাহাজে স্যাংশন রয়েছে, কোন জাহাজে নেই–তাঁদের উচিত ছিল এসবের খবর নেওয়া। এ রকম একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পের কাজের বিষয়ে আমাদের মিশনের পক্ষ থেকে আরও যোগাযোগ ও তদারকি হওয়ার প্রয়োজন ছিল।
রাশিয়ার কোন কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার ওপর স্যাংশন রয়েছে এসবের একটি তালিকা মস্কোর বাংলাদেশ মিশনের কাছে থাকা উচিত ছিল বলে মনে করি আমি। এক্ষেত্রে মস্কোর বাংলাদেশ মিশনে যে কিছু ঘাটতি ছিল উপর্যুক্ত ঘটনায় তা দেখা গেল। এবারের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মস্কোতে আমাদের যে মিশন রয়েছে, তাঁরা আরও তৎপর হবেন, এটা আশা করা যায়। বিশেষ করে, বিশ্বে এখন এই ধরনের নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার বিষয়গুলো আরও কঠিন হয়ে আসবে আগামী দিনগুলোতে।
আবার এই বিষয়গুলো আমেরিকাকেও বুঝতে হবে, আমাদেরও তাদের বুঝাতে হবে, এই ঘটনায় আমেরিকার প্রতি বাংলাদেশের মানুষের একটি নেতিবাচক মনোভাব তৈরি হবে। সেটা আমেরিকা কেন চাইবে! এই যুদ্ধটা আমরা এখন দেখছি পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার। সে যুদ্ধের ফলস্বরূপ আরোপিত নিষেধাজ্ঞার জন্য রাশিয়ার জাহাজ বাংলাদেশে ভিড়ল না, সেটি মালপত্র খালাস না করে আবার রাশিয়ায় ফিরে গেল। এর ফলে বৃথা সময় ব্যয় হলো। বাড়তি খরচ হলো।
অনেকেই একটা বিষয় বুঝতে পারছেন না সেটি হলো, বাংলাদেশের উৎপাদনের বাজার কিন্তু আমেরিকা। এখানে যত বেশি সময় লাগবে, তত পণ্য বা সেবা উৎপাদনে ব্যয় বাড়বে; এর প্রভাব পড়বে বাজারে। এখন যে দামে পণ্য দেওয়া যায়, এভাবে বিলম্বিত হতে থাকলে ব্যয় বেড়ে গেলে একটা পর্যায়ে সেই দামে আর দেওয়া যাবে না। এসব জেনেশুনে আমেরিকা এমন কেন করবে– এটা তাদের বোঝাতে হবে। কারণ, আমেরিকার সঙ্গে আমাদের যে বাণিজ্য সেটি একেবারেই ধনতান্ত্রিক কাঠামোর মধ্যে একটি বাণিজ্য নীতি মেনে করা হয়।
অন্য কথায়, এখানে যে রপ্তানিকারক এবং এখানে আমেরিকার যে বিনিয়োগকারী সবাই কিন্তু লাভ করার জন্যই আসেন। যদি তৈরি পোশাক খাতের কথাই বলি, আমেরিকার যে ব্যবসায়ীরা এগুলো আমদানি করেন, তাঁদেরই কিন্তু মুনাফার পরিমাণ বেশি। সেভাবে বলা যায়, আমেরিকার জনসাধারণও এই লাভের অংশীদার। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে এটি অস্বীকার করা যাবে না, এখানকার জ্বালানিশক্তির যদি দাম বাড়ানো হয়, তাহলে এর একটি প্রভাব আমেরিকান ব্যবসায়ীদের ওপরও পড়বে। একটা সময়ে গিয়ে আমেরিকান ভোক্তাদের ওপরও এই প্রভাব পড়বে। তাই আমেরিকাকে এই বিষয়টি বোঝানো উচিত, এহেন স্যাংশনের মাধ্যমে তাদের অর্থনীতির ওপরই কিন্তু প্রভাব পড়ছে। আজকে না হয়, কালকে– এই প্রভাব পড়বেই।
তবে আগামীর বিশ্ব যেহেতু সম্পূর্ণ বহুমাত্রিক সম্ভাবনার পথ নিয়ে আসছে, কোনো দেশ যদি এভাবে নিজের খেয়ালখুশি মতো চলতে থাকে, তবে একসময় তাদের বহির্বিশ্বের কাছে জবাবদিহির চেয়েও নিজের দেশের জনগণের কাছে অনেক বেশি জবাবদিহি করতে হবে। জনগণ কীভাবে লাভবান হবে, জনগণের চাহিদা কীভাবে পূরণ করা যায় এসব বিষয় কিন্তু নিজ নিজ রাষ্ট্র দেখে থাকে।
পৃথিবী যেহেতু বহু মেরূকরণের মধ্য দিয়ে যাবে, সেহেতু এসব বিষয়ে আরও সতর্ক হবে অনেক দেশ। বাংলাদেশও নতুন কোনো সম্পর্কে জড়ানোর আগে একবার-দু’বার নয়, দশবার বিশবার চিন্তা করবে– সম্পর্কটা করা ঠিক হচ্ছে কিনা? বিষয়টি সবারই খেয়াল রাখা দরকার। পৃথিবীকে আর এককভাবে বন্দি রাখা সম্ভব হচ্ছে না। অনেক রাষ্ট্রই উঠে এসেছে। তারা সম্পর্কের বহুমাত্রিকতা বজায় রাখতে পারছে।
আমরা যদি ভারত ও চীনের দিকে তাকাই তবে দেখতে পাব, আগের চিন্তা বা বিবেচনা দিয়ে তাদের আন্তঃসম্পর্ক যেমন বোঝা যাবে না, তেমনি ইউক্রেন-রাশিয়ার সঙ্গে দেশ দুটির সম্পর্কের স্বরূপও ব্যাখ্যা করা যাবে না।
আমার মনে হয়, বিশ্ব পরিসরে বহু মেরূকরণের বিষয়টি যখন আরও ব্যাপক হবে, তখন এই ধরনের বিষয় আরও স্পষ্ট হবে।
এসব বিষয় ব্যাখ্যা করার জন্য আমরা আরও ভালো উদাহরণ পেতে পারি জাতিসংঘের দিকে তাকালে। জাতিসংঘে বিভিন্ন বিষয়ে ভোটের দিকে তাকালে এই বিষয়টি পরিষ্কার হবে। ভারত, পাকিস্তান, চীন ও বাংলাদেশকে বিভিন্ন সময়ে বহু বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন মত ধারণ করতে দেখা যায়; কিন্তু এমনও দেখা যায়, কোনো একটি বিষয়ে এরা একমত হয়ে যায়।
ভারত-পাকিস্তান পরস্পর বৈরী হওয়া সত্ত্বেও ইউক্রেন-রাশিয়া ইস্যুতে একই রকম সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতিসংঘে। সর্বশেষ যে ভোটটি হলো, তাতে দেখা গেল বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তান সবাই ভোটদান থেকে বিরত থেকেছে। অথচ ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর পরও ভারত ও চীনের মধ্যকার সংঘাতময় সম্পর্ক নিয়ে বহু আলোচনা হয়েছে।
বর্তমানে যে বিশ্ব পরিস্থিতি তাতে কোনো দেশই আগ বাড়িয়ে এমন কিছু করতে চাইবে না, যাতে অভ্যন্তরীণ এবং বৈশ্বিক কোনো কিছুতে খুব বেশি পরিবর্তন আসে।
কোনো দেশই চাইবে না অন্য কোনো দেশের সঙ্গে এমন কিছু আচরণ করতে, যাতে উভয়ের মধ্যে সম্পর্কের ব্যাপক হানি হয়। আগামীর বহুমেরূকরণের বিশ্বে এই না চাওয়ার পরিমাণ আরও বাড়তে থাকবে।
আমার মনে হয়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং বাংলাদেশের রূপপুরের মালপত্র ডেলিভারির বিষয়ে যেসব ঘটনা ঘটে গেল, সেগুলো থেকে বহু কিছু শেখার আছে। আমরা আশা করব, রাশিয়া-বাংলাদেশ কিংবা বাংলাদেশ-আমেরিকার সম্পর্কগুলো নিয়ে যাঁরা কাজ করবেন, যাঁরা দ্বায়িত্বপ্রাপ্ত, তাঁরা তাঁদের পেশাদারিত্ব আরও বাড়াবেন। মিশনগুলোতে যাঁরা রয়েছেন তাঁরা চোখ-কান খোলা রাখবেন, সব বিষয়ে খোঁজখবর নেবেন, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন– এমনটাই প্রত্যাশিত। তাহলেই ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনার পুনরাবৃত্তি এড়ানো সম্ভব হবে বলে বিশ্বাস করি।
ড. ইমতিয়াজ আহমেদ: অধ্যাপক, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
মন্তব্য করুন