
ঢাকার স্থানীয় মানুষের মুখের ভাষাকে নির্ভেজাল বাংলা বলা যায় না। বলা যায় সোব্বাসী ও ঢাকাইয়া। সোব্বাসী ভাষা হিন্দি ও উর্দুর মিশ্রিত রূপ। স্থানীয়দের মধ্যে এই ভাষার প্রসার ঘটেছিল ঢাকার নবাবদের সংস্পর্শে। নবাব পরিবারের ভাষা ছিল চোস্ত উর্দু ঘরানার। নবাব বাড়িতে দরবার, বাগান, আস্তাবলসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে স্থানীয়রা নিয়োজিত ছিল। ওইসব মানুষের স্থানীয় ভাষা এবং নবাবদের বলা ভাষার মিশ্রণে কথ্য সোব্বাসী ভাষার উৎপত্তি ও বিকাশ। ঢাকার অপর অংশের স্থানীয়দের মধ্যে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষার আদলে মুখের ভাষা ছিল বাংলা ভাষারই কথ্যরূপ, যেটি ঢাকাইয়া ভাষা নামে খ্যাত। কৌতুক অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এই ঢাকাইয়া ভাষায় সর্বাধিক চলচ্চিত্র, নাটক ও কৌতুক নকশায় অনর্গল সংলাপ বলেছেন। তিনি গর্ব করে বলতেন– আমি বাঙাল, আমি ঢাকার ভানু।
মজার বিষয় হচ্ছে, নবাববাড়ির সোব্বাসীভাষী কর্মচারীরা নিজেদের অভিজাত জ্ঞান করত। অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবেও অগ্রসর ছিল সোব্বাসীভাষীরা। তাদের পক্ষে ধনী নবাব পরিবারের সান্নিধ্য লাভ সম্ভব হতো জীবিকাজনিত কারণে। অল্পবিস্তর শিক্ষালাভও ঘটেছিল তাদের। সোব্বাসীভাষীরা ঢাকাইয়াভাষীদের কুট্টি এবং ঢাকাইয়াভাষীরা সোব্বাসীভাষীদের ‘হামোকা তোমোকা’ বলে উপহাস করত। সোব্বাসীভাষীরা যেমন বলত– মেরে আম্মিনে সেরবেনের পাকইস। অর্থাৎ আমার মা ফিরনি রেঁধেছে। আপ কাঁইয়ে। অর্থাৎ আপনি বলুন ইত্যাদি। এ ধরনের ভাষাই সোব্বাসী নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। দুই ভাষাভাষীর মধ্যে খুনসুটি-বৈরিতা যেমন ছিল; তেমনি সামাজিক ক্ষেত্রে পারতপক্ষে কেউ কারও সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে আবদ্ধ হতো না ওই ভাষার কারণেই।
ধর্মীয় উৎসব-পার্বণের পাশাপাশি স্থানীয়দের নিজস্ব সাংস্কৃতিক বলয় গড়ে উঠেছিল। সেগুলো ছিল যেমন স্বাতন্ত্র্যে, তেমনি স্বকীয়তায়। চৈত্রসংক্রান্তিতে মেলা হতো। স্থানীয়দের ভাষায় ‘চৈত্র পূজার মেলা’। হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সবাই দর্শক বা ক্রেতা হিসেবে মেলায় যোগ দিত। ঘুড়ি ওড়ানোকালে নিত্যদিন দেখা যেত। তবে সাকরাইন ঘুড়ি উৎসবে বাড়ির ছাদে, বুড়িগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলজুড়ে, খোলা মাঠে ঘুড়ি ওড়ানো উৎসবের আদলে পালিত হতো। বর্ষা মৌসুমে টইটম্বুর বুড়িগঙ্গা নদীতে সাঁতার প্রতিযোগিতা, নৌকাবাইচের আয়োজন ছিল অপরিহার্য। স্থানীয়দের উদ্যোগে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সাঁতারু, দীর্ঘ লম্বা আকৃতির বাইচের নৌকা এসে ভিড় করত। রোজার শেষদিকে স্থানীয় যুবকরা গানের দল গঠন করে ভোর রাতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে গান করে চাঁদা তুলত। স্থানীয় ভাষায় বলা হতো ‘কাসিদা’।
স্থানীয়রা গানের ভক্ত ছিল। বিয়েসহ অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মাইক বাজানো ছিল অপরিহার্য। মাইকে দিন-রাত হিন্দি, উর্দু গানের পাশাপাশি বাংলা গানও বাজত। তাদের সেরা বিনোদনের উপকরণ ছিল প্রেক্ষাগৃহে গিয়ে ছবি দেখা। স্থানীয়রা উর্দু, বাংলা দুই ভাষার ছবি দেখতেই প্রেক্ষাগৃহে ছুটত। স্থানীয়রা সব ধরনের সাংস্কৃতিক উপভোগে নিজেদের যুক্ত রাখত। সাংস্কৃতিক অনুরাগী হিসেবে দর্শক-শ্রোতা হিসেবে তাদের উপস্থিতি বরাবরই ছিল।
ইতিহাস থেকে জানা যায়, ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত একুশে ফেব্রুয়ারিতে পুলিশের গুলিতে ছাত্র হত্যার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে স্থানীয়দের মধ্যেও তীব্র ক্ষোভ-বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ছাত্রদের আন্দোলনের সীমানা পেরিয়ে দেশজুড়ে ক্ষোভের সঞ্চার করে। সারা পূর্ববাংলার মানুষের মতো স্থানীয়দেরও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। ছাত্র হত্যার আগে ভাষা আন্দোলন দেশবাসীর ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির হত্যাকাণ্ডের পর ভাষা আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠে। স্থানীয়দের মধ্যেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন সবেগে বিস্তার লাভ করে।
প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে আর্থিক সাহায্য এবং নির্মাণসামগ্রী পাওয়া ছিল কষ্টকর। কিন্তু পুরান ঢাকার হোসেনি দালান অঞ্চলের স্থানীয় ঠিকাদার-ব্যবসায়ী পেয়ারু সর্দার তাঁর গোডাউন থেকে ইট-বালু-সুরকি, রড-সিমেন্ট ইত্যাদি সরবরাহ করে প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণে সহযোগিতা করেছিলেন। স্থানীয়রা নিজেদের সোব্বাসী ও ঢাকাইয়া আঞ্চলিক ভাষাকে অতিক্রম করে মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে এবং ভাষা ও জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল।
মনে পড়ে, একুশে ফেব্রুয়ারির প্রভাতফেরিতে খালি পায়ে বুকে কালো কাপড়ের ব্যাজ লাগিয়ে প্রতিবারই স্থানীয় ক’জন বন্ধু ও সহপাঠী যেতাম আজিমপুর কবরস্থানে। সেখান থেকে শহীদ মিনার। ১৯৬০-এর দশকের শেষদিকের এমনই এক প্রভাতফেরিতে আজিমপুর কবরস্থানে গিয়ে দেখি নায়ক রাজ্জাককে প্রচুরসংখ্যক মানুষ ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে কবরস্থানের দিকে। তাঁর পরনে হলুদ পাঞ্জাবি ও সাদা পায়জামা। জহির রায়হান (প্রয়াত) গলায় আলো মাপার যন্ত্র ঝুলিয়ে ছটফট করছেন। ক’জন মানুষ তাঁদের উদ্দেশে ক্ষুব্ধ স্বরে বলছে, ‘শোক দিবসে উনারা এসেছেন সিনেমার শুটিং করতে! ফালতু যত্তসব!’ তখন কেউ কি ভেবেছিল, নির্মীয়মাণ ‘জীবন থেকে নেয়া’ ছবিটি স্বাধিকার আন্দোলনে কতটা আমাদের প্রভাবিত ও চেতনার জগৎকে শানিত করবে? উৎসুক মানুষের জটলা-হঠকারিতা ছবিটির শুটিংয়ের কাজে নির্মাতা-তারকাদের বিস্তর ভোগান্তি দিয়েছিল সেদিন।
মযহারুল ইসলাম বাবলা: নির্বাহী সম্পাদক, নতুন দিগন্ত
মন্তব্য করুন