গত বছর ইন্দোনেশিয়ার বালিতে যে জি২০ শীর্ষ সম্মেলন হয়েছিল, তা মূলত ব্যর্থ; এবং ইউক্রেন যুদ্ধ ছিল এর অন্যতম কারণ। একটি অর্থনৈতিক ফোরামের সভায় রাজনৈতিক বিষয়কে ঠেলে দিয়ে গ্রুপ অব ৭ (জি৭) দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জি২০ শীর্ষ সম্মেলনকেও অকার্যকর করার পথে রয়েছে। গত সপ্তাহে দিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের সভায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ দিল্লির শ্রোতাদের স্মরণ করিয়ে দেন, যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র ন্যাটো গত ২৫ বছরে এশিয়া ও আফ্রিকাজুড়ে যুদ্ধ চালিয়েছিল, তখন জি২০তে বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলোচনা হয়নি। যদিও এটি বোধগম্য, ইউরোপীয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব জনগণের চাপের মধ্যে রয়েছেন, যাতে তাঁরা রাশিয়াকে নিন্দা করার জন্য প্রতিটি বৈশ্বিক প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন। ইউরোপীয়দের জীবন কি এশিয়ান ও আফ্রিকানদের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ?

ভূ-রাজনীতির খেলা যে নৈতিকতা-বিবর্জিত– সেটাই এই ধরনের ভণ্ডামির কারণ। কিন্তু সাম্প্রতিক জি৭-এর পদক্ষেপ এই প্রশ্ন সামনে আনছে, তারা রাজনৈতিক চাপে দিল্লি শীর্ষ সম্মেলনকে বিপর্যস্ত দেখতে ইচ্ছুক কিনা। সম্প্রতি বেঙ্গালুরু ও নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি২০ সদস্যভুক্ত দেশগুলোর অর্থ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে দেখা যাচ্ছে, জি২০ তিনটি গ্রুপে বিভক্ত– জি৭, চীন ও  রাশিয়া। পূর্ব-পশ্চিম সংঘাতের মধ্যে ভারত শক্ত পথে হাঁটার চেষ্টা করেছে। তারা ঘোষণা করেছে– জি২০ হবে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর কণ্ঠস্বর। নরেন্দ্র মোদি এ অঞ্চলের উনয়নমূলক স্বার্থকে এগিয়ে নিতে একটি উচ্চাভিলাষী এজেন্ডা নির্ধারণ করেছেন।

জি৭ এই এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে সামান্যই আগ্রহ দেখিয়েছে। আর অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর উভয়ের বিবৃতি বলছে, নরেন্দ্র মোদিকেও সেপ্টেম্বরে চেয়ারম্যানের বিবৃতি দেওয়ার মধ্যেই সন্তুষ্ট থাকতে হবে। কারণ, কোনো বিষয়ে এর সদস্য দেশগুলোর মধ্যে ঐক্য নেই।

জি৭-এর সাম্প্রতিক কর্মতৎপরতা ইঙ্গিত করছে, উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো পরস্পরের স্বার্থ রক্ষার চক্করেই রয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, ১৯৯৭-৯৮ সালের এশিয়ার অর্থনৈতিক সংকটের পর গুরুত্বপূর্ণ দেশের অর্থমন্ত্রীদের সমাবেশ হিসেবে জি২০ প্রতিষ্ঠা হয়েছে ১৯৯৯ সালে। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটি শুধু অর্থমন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলন ছিল। ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বরে আটলান্টিকপাড়ের অর্থনৈতিক সংকট যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে আঘাত হানে, তখন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ক্যাম্প ডেভিডে মিলিত হন। তাঁরা সিদ্ধান্ত নেন, অর্থনৈতিক সংকটের প্রভাব পড়েছে এমন দেশগুলোর প্রধানদের মধ্যে একটি জরুরি বৈঠক ডাকা উচিত, যাতে দ্রুত সংকট মোকাবিলা করে আটলান্টিকপাড়ের অর্থনীতি স্থিতিশীল করা যায়। বুশ ও সারকোজি উভয়েই উপলব্ধি করেছিলেন, বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থাকে স্থিতিশীল করতে এবং বৈশ্বিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বজায় রাখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের চীনের সহায়তা প্রয়োজন হবে। তাদের কাছে একটি বিকল্প ছিল– চীনকে আমন্ত্রণ জানিয়ে জি৮ সম্প্রসারণ করে জি৯-এ পরিণত করা। আসল জি৭ (কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র)। জি৮ হয় ১৯৯৭ সালে বরিস ইয়েলেতসিনের রাশিয়ার অন্তর্ভুক্তির মাধ্যমে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যখন রাশিয়ার শক্তি পুনর্গঠন শুরু করেন এবং ২০১৪ সালে মস্কো ক্রিমিয়া দখল করে, তখন রাশিয়াকে জি৮ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ উভয়েই সিদ্ধান্ত নেন, শুধু চীনকে আমন্ত্রণ জানানোর পরিবর্তে অর্থমন্ত্রীর বদলে সরকারের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধ্যমে একে জি২০তে সম্প্রসারণ করা দরকার। এ সিদ্ধান্ত ভারত, ইন্দোনেশিয়া, ব্রাজিল, দক্ষিণ আফ্রিকা এবং অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশকে সন্তুষ্ট করেছিল। কারণ তারা এর ফলে সবাই অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও আন্তর্জাতিক অর্থ সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের বিষয়ে প্রধান শক্তিগুলোর সঙ্গে আলোচনায় মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। প্রথম তিনটি জি২০ সম্মেলন ২০০৮-০৯ সালে ওয়াশিংটন (যুক্তরাষ্ট্র), লন্ডন (যুক্তরাজ্য) ও পিটসবার্গে (যুক্তরাষ্ট্র) অনুষ্ঠিত হয় এবং সেগুলোর মাধ্যমে ব্যাপক সফলতা অর্জিত হয়। সেসব সম্মেলনে সরকারপ্রধানরা বিভিন্ন নীতি ও প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ বিষয়ে ঐকমত্য পোষণ করেন, যার মাধ্যমে বিশ্ব অর্থনীতি, বৈশ্বিক ব্যাংকিং, আর্থিক ব্যবস্থা ও ইউরো স্থিতিশীল হয়। ওইসব সম্মেলনের সাফল্যের চাবিকাঠির মূল কারণ ছিল, তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যকার সম্পর্ক ভালো ছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক অর্থমন্ত্রী হ্যাঙ্ক পলসন তাঁর চীনা প্রতিপক্ষের সঙ্গে সংকট মোকাবিলায় যে দীর্ঘ সময় ব্যয় করেছেন, সে সম্পর্কে বিস্তারিত লিখেছেন। ২০০৯ সাল ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সম্পর্কের মাইলফলকের বছর। চীন পরবর্তী সময়ে দ্রুত প্রবৃদ্ধি বজায় রাখে এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কেরও দূরত্ব বাড়তে থাকে।

এর পর সব নদী দিয়েই অনেক জল প্রবাহিত হয়েছে। তবে জি২০-এর পরবর্তী সম্মেলনগুলো খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। এ সময়ে যেমন মার্কিন-চীন ও মার্কিন-রাশিয়া সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, তেমনি গ্লোবাল সাউথ (লাতিন আমেরিকা, আফ্রিকা, এশিয়া ও ওশেনিয়া) থেকে দেশগুলো শক্তিশালী হয়ে ওঠে এবং তারা জি২০কে বিশেষ এজেন্ডায় রূপ দিতে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এবার জি২০- এর সভাপতি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি জওহরলাল নেহরুকে পুনঃআবিষ্কার করেন এবং ‘গ্লোবাল সাউথের কণ্ঠ’ আরও জোরালো করার পথ বেছে নেন।

জি২০কে রাশিয়াবিরোধী প্রচারণার সঙ্গে রাজনীতিকীকরণ করার পর জি৭ ‘গ্লোবাল সাউথ’ এজেন্ডা থেকেও সতর্ক বলে মনে হয়। রাশিয়া সম্পর্কে দিল্লির অবস্থান যদি জি৭-এর সঙ্গে সংগতিপূর্ণ না হয়, তবে ‘গ্লোবাল সাউথ’ দিল্লিতে অনুষ্ঠিতব্য জি২০ শীর্ষ সম্মেলন থেকে উল্লেখযোগ্য কিছু লাভ করতে পারবে বলে মনে হয় না। এমনকি জি২০ শীর্ষ সম্মেলনের যে আয়োজন ভারত করছে, সেখানে উদযাপন অনুষ্ঠানে প্রদর্শিত লালগালিচা ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর পায়ের নিচ থেকে টেনে নেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

সম্ভবত জি৭ এখনও উন্নয়নশীল অর্থনীতির স্বার্থসংশ্লিষ্ট সমস্যা মোকাবিলায় ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করবে; যেমন বৈদেশিক ঋণ, জলবায়ু অর্থায়ন ও প্রযুক্তি এবং বাজারে প্রবেশের অনুমতি, যদি তারা রাশিয়া ও চীনের নিন্দা করে। ভারত হয় ফলাফল ছাড়াই শীর্ষ সম্মেলন শেষ করতে পারে কিংবা তাকে জি৭-এর সঙ্গে তাল মেলানোর পথ ধরতে হবে। বস্তুত জি২০ বিশ্ব অর্থনৈতিক শাসনের সঙ্গে তার প্রাসঙ্গিকতা হ্রাসের হুমকির সম্মুখীন। বিশ্ব অর্থনীতির ব্যবস্থাপনায় জি২০-এর গুরুত্ব তুলে ধরে ভারত এখনও তার উদ্ভাবনী কূটনীতির মাধ্যমে একটি ইতিবাচক ফল পেতে পারে। অথবা জি২০ আয়োজন বাদ দিয়ে সবাইকে বিশ্রাম দিতে পারে; আয়োজক নেতা, জাতি, লালগালিচা, উজ্জ্বল আলো এবং ছবি তোলার মতো সবকিছুকে।

সঞ্জয়া বারু: ভারতের নীতি বিশ্লেষক; ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক