- সম্পাদকীয় ও উপসম্পাদকীয়
- রাজনীতি থেকে ইমরানের অপসারণ সমাধান নয়
পাকিস্তান
রাজনীতি থেকে ইমরানের অপসারণ সমাধান নয়

পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন পাঞ্জাবের নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেছে ৩০ এপ্রিল। মূলত সুপ্রিম কোর্টের হস্তক্ষেপের ফল হিসেবেই সাংবিধানিক নির্দেশনা মেনে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এ জন্য সর্বোচ্চ আদালতকে ধন্যবাদ। তবে খাইবার পাখতুনখোয়ার নির্বাচন ডিউ হলেও তা কবে হবে, কেউ বলতে পারছে না। কারণ কর্তৃপক্ষ এখনও চাঁদের হিসাবে শুভদিন খুঁজে পাচ্ছে না; অথবা নির্বাচন কমিশন ও রাজ্য গভর্নর নির্বাচন অনুষ্ঠানের দিনক্ষণ নিয়ে একমত হতে পারছেন না।
এদিকে, নির্ধারিত দিনে পাঞ্জাবে নির্বাচন হবে কিনা, তা নিয়ে এখনও শঙ্কা রয়েছে। সাংবাদিক ও রাজনীতিবিদরা তাঁদের নিজস্ব সূত্রের বরাত দিয়ে– নির্ধারিত দিনে নির্বাচন হবে না বলে দাবি করে চলেছেন। আমার শঙ্কা, একবার প্রাদেশিক নির্বাচন বিলম্বিত হলে জাতীয় নির্বাচনও হয়তো একই ভাগ্য বরণ করবে। এটি একটি বাইক চালানোর মতো। আপনি একবার পড়ে গেলে পরের বার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আরও সহজ।
তবে কীভাবে নির্বাচনটি হবে, সেটা ‘ওপেন সিক্রেট’। যদি সুপ্রিম কোর্টের আদেশ ও সংবিধান লঙ্ঘন হয়, তাতে কি পার্থক্য সূচিত হবে? আদালতের আদেশ লঙ্ঘনের শঙ্কা জেগেছে এ কারণে যে, কতজন বিচারক পক্ষে আর কতজন বিপক্ষে রায় দিলেন– এ হিসাবজনিত উত্তেজনা শেষ হওয়ার পরই সরকার তার পুরোনো যুক্তিতে ফিরে যাবে; তা হলো প্রয়োজনীয় নিরাপত্তার অভাব। অবশ্য এমনটা ঘটতে পারে একটি সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার অভাবেও। কিন্তু এটি শুধু একটি অনুমান। আমরা কি ‘ভালো সময়’-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকব, যাতে নির্বাচনের ফলাফল স্বাভাবিকভাবেই ভিন্ন হয়?
সর্বোচ্চ কেউ বলতে পারে নির্বাচন বিলম্বিত করতে হবে। কারণ ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ পিটিআইকে জিততে দেওয়া যাবে না। এখানে অন্যদিকও হয়তো রয়েছে যে, নির্বাচনে সবার জন্য ক্ষেত্র সমতল করতে বিলম্ব প্রয়োজন, যা ইমরান খানের জয়ের মাত্রা হ্রাস করবে। প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের মাঠ সমতলকরণের প্রয়োজন কী? ইমরান খানকে গ্রেপ্তার করা? নাকি নির্বাচনের আগে তাঁকে অযোগ্য ঘোষণা করা? নাকি ভোটের মহড়ার আগে নওয়াজ শরিফের অযোগ্য ঘোষণার বিষয়টি বাতিল করা? আবারও আমাদের কাছে একটি চটকদার শিরোনাম রয়েছে, তবে বিশদ গল্প নেই। কিন্তু এখানে একটা সমস্যা আছে। সবার জন্য সমতল খেলার মাঠ তৈরি ও ন্যায়বিচারের দিকেই আমাদের দৃষ্টি; অর্থনীতিকে মোকাবিলা করার জন্য কোনো সময় অবশিষ্ট নেই?
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি এক ব্যক্তির ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, যিনি তাঁর কয়েক মাসের শাসনামলে আইএমএফ বা পাকিস্তানি ভোটার– কাউকেই প্রভাবিত বা আশ্বস্ত করতে পারেননি। এমনকি উচ্চ পদে থাকা কেউ তাঁকে জিজ্ঞাসাও করছেন না– তাঁর পরিকল্পনা কী। অথবা এমনও প্রশ্ন করা হচ্ছে, যেখানে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে এত অনিশ্চয়তা, সেখানে পরিকল্পনা করা সম্ভব কিনা। যদি বর্তমান আইএমএফের কর্মসূচি পাকিস্তানকে ছেড়ে চলে যায় এবং গ্রীষ্মে নতুন কর্মসূচি নিয়ে তৃষ্ণার্ত পাকিস্তানে আসার কথা বলে (যার অর্থ পাকিস্তানে আমরা বুঝতে পারি, জনগণের কোনো অর্থনৈতিক স্বস্তি নেই), আসলে কতক্ষণ বিলম্বের পরিকল্পনা করা হচ্ছে? এবং এর শেষ কোথায়? আমরা কি ‘ভালো সময়’-এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকব, যাতে নির্বাচনের ফল স্বাভাবিকভাবে ভিন্ন হয়, নাকি আমরা একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের মরীচিকা বেছে নেব, যা আবার আমাদের আরও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনী পছন্দের পথে নিয়ে যাবে? ১০ বছর আগে অর্থনীতিতে এই সংশোধনের প্রয়োজন ছিল, তার জন্য এটি নির্ধারণ করতে কত সময় লাগবে? এর মধ্যে এবং পিটিআই ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ (নওয়াজ) তথা পিএমএল-এনের ন্যায়বিচারের ধারণা মূল বিষয় হওয়া উচিত নয়। বস্তুত অর্থনীতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া হলে, যারা পিটিআইর জয়ে ভয় পায়, এটি তাদের প্রশ্নেরও উত্তর হবে।
পাকিস্তানের বিকৃত অর্থনীতির কারণে এক ধরনের জনতুষ্টিবাদ বা পপুলিজম তৈরি হয়েছে, যা পিটিআই এবং তার নেতাকে জনপ্রিয় করে তুলেছে। ইমরান খানের জনপ্রিয়তা শুধু একটি অসম ব্যবস্থার প্রতি জনগণের ক্ষোভের উপসর্গ মাত্র, যেখানে জনগণের চাহিদা পূরণে কোনো স্ব-সংশোধন ব্যবস্থা নেই। অন্যায্য জগতের প্রতি তাদের ক্রোধে তারা নিজেদের খুঁজে পায়। তারা এমন একজন নেতাকে বেছে নেয়, যে শুধু বিদ্যমান ব্যবস্থার বিরুদ্ধে দাঁড়ায় না; বরং তাকে এর অংশ হতেও দেখা যায় না। বাকি রাজনৈতিক নেতৃত্ব দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করছেন এবং তাই তাঁরা বিদ্যমান ব্যবস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত।
ইমরান খানকে রাজনৈতিক ময়দান থেকে সরানোর চেষ্টা করার চেয়ে অসন্তোষসৃষ্ট সমস্যাগুলোর সমাধান অনেক সহজ (এবং পাকিস্তানের স্থিতিশীলতার জন্যও তা সহায়ক) হবে। কিন্তু আমাদের প্রবণতা হলো, সামনের পথ দেখে সংক্ষিপ্ত পথ বেছে নেওয়া, যাতে শুধু হারিয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমানো যায়।
অর্থনীতির কাঠামোগত সংস্কার, যা শুধু প্রবৃদ্ধিই বাড়াবে না, বরং আরও ন্যায়সংগত বণ্টন নিশ্চিত করবে এবং জীবনযাত্রার মান উন্নত করবে, তা জনগণের ক্ষোভও কমিয়ে দেবে। এর জন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে নজর দিতে হবে, যদিও তা মেনে নেওয়া অনেকের জন্য কঠিন। সেটা হলো, বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্তদের ওপর ট্যাক্স আরোপ করে সমতা বিধান করা। এর মধ্যে ট্যাক্সের হার বাড়ানো এবং বাণিজ্যিক শ্রেণির পাশাপাশি কৃষি আয়ের ওপর কর আরোপ করাও অন্তর্ভুক্ত। একই সঙ্গে এর অর্থ রিয়েল এস্টেট থেকে বিনিয়োগ দূরে সরিয়ে দেওয়া। এর কোনোটিই গোপন নয়; শুধু কঠিন এর বাস্তবায়ন। এর চেয়ে বোধ হয় অলৌকিক কিছুর জন্য আশা করা সহজ।
কিন্তু আমরা অর্থনৈতিক সংস্কার দিয়েই সব সমস্যার সমাধান করতে পারব না। এ জন্য রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেও জনগণের প্রয়োজনের প্রতি সাড়াদানে আন্তরিক হতে হবে। পাকিস্তানের শক্তিশালী স্থানীয় সরকার প্রয়োজন। এটি জরুরি, কারণ স্থানীয় সরকার প্রাদেশিক সরকারগুলোর চেয়ে অনেক বেশি অর্থ বিতরণ করে এবং জনগণের কাছে পৌঁছায়। এই সবকিছু ক্রোধ মোকাবিলা করতে সাহায্য করবে, যা জনতুষ্টিবাদী প্রত্যাশার মধ্যে আরও স্থিতিশীল ও সমৃদ্ধ পাকিস্তানের ভিত্তি স্থাপন করবে। তবে এটা তখনই করা যেতে পারে, যখন এ উপলদ্ধি আসবে– দেশকে জোর করে অতীতে ফিরিয়ে নেওয়া সাফল্যের রেসিপি নয়। পরিবর্তন বোঝা এবং সে অনুযায়ী চলাই অগ্রগতির একমাত্র পথ। বলা বাহুল্য, টাইম মেশিন শুধু কল্পকাহিনিতেই বিদ্যমান।
আরিফা নূর: পাকিস্তানের সাংবাদিক; ডন থেকে ঈষৎ সংক্ষেপিত ভাষান্তর মাহফুজুর রহমান মানিক
মন্তব্য করুন