চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নিবাস বিশেষত ছাত্রদের হলগুলি ক্ষমতাসীন দল-সমর্থক ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মী বিভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত হইয়া চর দখলের অনুরূপ দখল করিয়া তথায় নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে বলিয়া বুধবার সমকাল যে খবর দিয়াছে, উহা দুঃখজনক হইলেও বিস্ময়কর নহে। প্রতিবেদনে বলা হইয়াছে, হলগুলিতে ছাত্রলীগের সংশ্লিষ্ট দখলদার গোষ্ঠীর শীর্ষ নেতার মুখের কথাই আইন; তাঁহার অনুমোদন ব্যতীত কোনো ছাত্রই তথায় অবস্থান করিতে পারে না। ফলে মেধার ভিত্তিতে হল প্রশাসনের অনুমতি লইয়া সাধারণ ছাত্রদের হলে অবস্থানের যে নিয়ম একদা বিশ্ববিদ্যালয়টিতে বহাল ছিল, উহা এখন সম্পূর্ণই অতীতের বিষয় হইয়া দাঁড়াইয়াছে। এই অবস্থায় কাহারও বুঝিতে কষ্ট হইবার কথা নহে, দেশের অন্যতম খ্যাতনামা উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সাধারণ শিক্ষার্থীরা কতটা কষ্টে দিনাতিপাত করিতেছে এবং তথায় শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ কতটুকু রহিয়াছে।

তবে ইতোপূর্বে যেমনটা বলা হইয়াছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামসহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখা প্রতিষ্ঠানটিতে স্বৈরতন্ত্রের এহেন বাড়বাড়ন্ত দেখিয়া আমরা মোটেও বিস্মিত নই। কারণ, তথাকার ছাত্রলীগ বহু বৎসর ধরিয়া নানা গোষ্ঠীতে বিভক্ত এবং গোষ্ঠীসমূহের মধ্যকার সংঘাত-সংঘর্ষে ইতোপূর্বে বহু শিক্ষার্থীর প্রাণ ঝরিয়াছে। তৎসত্ত্বেও চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের দুই দিকপালের আশীর্বাদধন্য বেপথু ছাত্রলীগ নেতাকর্মীকে নিয়ন্ত্রণে অদ্যাবধি কেহই আগাইয়া আসে নাই। কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগও যেমন এই দুষ্ট কর্মীদের লাগাম পরাইতে তেমন উদ্যাগী হয় নাই; তেমনি আওয়ামী লীগ বা সরকার যদিও দিনশেষে উহার দায় তাহাদেরই শুধিতে হইবে– অনেকটা উষ্ট্রপক্ষীবৎ মুখ গুঁজিয়া রহিয়াছে।
সরকার, শাসক দল ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ অবশ্য শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েই নহে; প্রায় সমগ্র দেশেই ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনার বিষয়ে এক প্রকার মৌনব্রত পালন করিতেছে।

গত ১৪ বৎসরে বিভিন্ন সময় দেশের অত্যন্ত ঐতিহ্যবাহী সংগঠনটির নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনসমূহের সহিত প্রাণঘাতী সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়া এবং নিজেদের মধ্যে খুনাখুনি, হল-ক্যাম্পাস দখল, টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি, অপহরণ, এমনকি ফৌজদারি অপরাধ ধর্ষণের অভিযোগও উঠিয়াছে। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই সংগঠনটির অভিভাবকরা অপরাধীদের উদ্দেশে শক্ত কোনো বার্তা দিয়াছেন। কখনও কখনও কোনো অভিযুক্তকে বহিষ্কার, এমনকি বিচারের মুখোমুখি করা হইলেও উত্তপ্ত পরিস্থিতি স্তিমিত হইবার পর বহিষ্কৃত অনেকেই আপন সংগঠনে ফিরিয়া আসিয়াছে এবং বিচারের প্রক্রিয়া গতি হারাইয়াছে। খোদ প্রধানমন্ত্রীকে আমরা ছাত্রলীগের দুষ্ট নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে অদ্যাবধি একাধিকবার সতর্কবার্তা উচ্চারণ করিতে দেখিলেও পরিস্থিতির ইতরবিশেষ ঘটে নাই।

ইহা অনস্বীকার্য, উক্ত দখলদারদের সহিত শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতি ত্যাগ করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং হল প্রশাসন হল ও ক্যাম্পাসের ওপর স্বীয় আইনসংগত কর্তৃত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠায় কার্যকর প্রয়াস এ অবস্থায় কিছুটা হইলেও পরিবর্তন ঘটাইতে পারিত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক, চরম দলবাজি ও বিভিন্ন প্রকার অনিয়ম-দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হইয়া তাহারা বহু পূর্বেই এহেন পদক্ষেপ গ্রহণের নৈতিক বল হারাইয়াছে। আসলে পূর্বসূরিদের অনুসরণ করিয়া বর্তমান সরকার বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেরূপ নিছক দলীয় বিবেচনায় উপাচার্যসহ বিভন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দিয়াছে, উহার কারণে কোনো শক্ত মেরুদণ্ডসমৃদ্ধ বা মর্যাদাবান ব্যক্তির বিশ্ববিদ্যালয় বা হল প্রশাসনে স্থান পাওয়ার সুযোগ ছিল না। ফলে শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নহে, সর্বত্র আমরা হতাশাজনক হইলেও প্রশাসনকে ছাত্রলীগের দুর্বৃত্তপনার সহযোগীরূপে দেখিতে পাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘গেস্টরুম কালচার’ নামে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নেতাদের নির্যাতন এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে হল প্রশাসনের অনুমতি সত্ত্বেও বিভিন্ন হলে ছাত্রলীগের বাধার কারণে সাধারণ শিক্ষার্থীর অবস্থান করিতে না পারিবার বিষয়গুলি উহারই প্রতিফলন ঘটাইতেছে। তবে আমরা মনে করি, সরকার বা দল বড় কোনো খেসারত পরিহার করিতে চাহিলে এখনই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ সর্বত্র ছাত্রলীগকে শক্ত লাগাম পরাইতে হইবে।

বিষয় : সম্পাদকীয় উষ্ট্রপক্ষী

মন্তব্য করুন