দেশে করোনা-পরবর্তী নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিলেও চিকিৎসা মিলছে না। অনেকেই চিকিৎসা নিতে হাসপাতালে আসছেন। এসব রোগীর সেবা নিশ্চিতে মহামারির শুরুতে প্রতিটি হাসপাতালে পোস্ট কভিড ক্লিনিক বা সেন্টার চালু করা হয়েছিল। তবে এসব ক্লিনিক এখন বন্ধ। এতে ভোগান্তি পোহাচ্ছেন রোগীরা।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, গত তিন বছরে অনেকে একাধিকবার করোনায় আক্রান্ত হয়ে সুস্থ হয়েছেন। তাঁরা ভাইরাসটি থেকে মুক্ত হলেও কো-মরবিডিটিতে (দীর্ঘমেয়াদে বিভিন্ন রোগব্যাধিতে আক্রান্ত) ভোগা ব্যক্তিদের পুনরায় শারীরিক জটিলতা দেখা দিচ্ছে।  অন্যান্য দেশে করোনা-পরবর্তী নানা জটিলতার সেবা নিশ্চিতে ক্লিনিক সেবা চালুসহ নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। করোনা-পরবর্তী কী কী রোগ বাড়ছে, এটা নিয়ে গবেষণা হচ্ছে প্রতিনিয়ত। তবে দেশে এমন উদ্যোগ নগণ্য।

গতকাল শুক্রবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বহির্বিভাগের সামনে কয়েকজন রোগী জানান, করোনা-পরবর্তী জটিলতা দেখা দিয়েছে তাঁদের শরীরে।

আব্দুল আলিম নামে একজন বলেন, গত ডিসেম্বরে তাঁর মা করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। এখন হঠাৎ কাশি ও শ্বাসকষ্ট দেখা দেওয়ায় ঢামেকে নিয়ে এসেছেন। গেটের সাঁটানো সাইনবোর্ডে ‘পোস্ট কভিড ক্লিনিক’ লেখা দেখে চারতলায় যান। কিন্তু সেখানে কাউকে খুঁজে পাননি। তাঁর মতো আরও কয়েক রোগী ও স্বজন ক্লিনিকটি খুঁজছিলেন।

পরে হাসপাতাল-সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ক্লিনিকটি ভবন-২ এর পঞ্চম তলায় অবস্থিত। একজন চিকিৎসকের পরামর্শে ৫৪৫ নম্বরে গেলে অস্টিওপোরোসিস ও অস্টিওআর্থ্রাইটিস ক্লিনিক লেখা সাইনবোর্ড সংবলিত কক্ষটি তালাবদ্ধ পাওয়া যায়। পাশের ওয়ার্ডের নার্সিং ইনচার্জ সুলতানা আক্তার সমকালকে জানান, পোস্ট কভিড রোগী কম আসায় এটি বন্ধ রাখা হয়েছে। ২০২০ সালের জুলাই মাসের দিকে ক্লিনিকটি চালু হয়, তখন রোগীর সংখ্যা বেশি ছিল। সে তুলনায় এখন রোগী নেই বললেই চলে।

২০২০ সালের ৮ মার্চ দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। ১৮ মার্চ প্রথম মৃত্যু হয়। সে হিসাবে আজ করোনায় মৃত্যুর তিন বছর পূর্ণ হলো। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানায়, দেশে ১৫ কোটি ৩৩ লাখ নমুনা পরীক্ষা করে গতকাল সকাল পর্যন্ত এ ভাইরাসে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্ত হয়েছেন ২০ লাখ ৩৭
হাজার ৯৫৪ জন। মৃত্যু হয়েছে ২৯ হাজার ৪৫৪ জনের।

তবে করোনা-পরবর্তী জটিলতায় কত মানুষের মৃত্যু হচ্ছে, সেই তালিকা সরকারের হাতে নেই। অন্য কোন কোন জটিলতায় প্রাণহানি ঘটছে, তা নিয়েও কোনো গবেষণা হয়নি। তবে করোনাকালে কী ধরনের অসুস্থতা নিয়ে মানুষ হাসপাতালে এসেছেন, তা বুঝতে সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআরবি) গবেষণা চালায়। এতে দেখা গেছে, করোনা-পরবর্তী সময়ে ডায়াবেটিস, মানসিক সমস্যা, ফুসফুসের জটিলতা বেশি দেখা দিচ্ছে। সে ক্ষেত্রে তাদের ইনসুলিন নিতে হচ্ছে। এ ছাড়া করোনার ধকল কাটিয়ে ওঠার পর কারও কারও মানসিক অবসাদ ও স্মৃতিশক্তি লোপের সমস্যা বেড়েছে। কাজে মনোযোগ দিতে তাঁদের সমস্যা হচ্ছে।

এ ছাড়া করোনাকালে চিকিৎসা নিতে আসা ব্যক্তিদের মানসিক অসুস্থতার ধরন জানতে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল একটি জরিপ পরিচালনা করে। এতে দেখা গেছে, ৩৩ শতাংশ রোগীর করোনা সম্পর্কিত দুশ্চিন্তা বা উদ্বেগ ছিল। তাঁরা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভাইরাসটিতে ক্ষতিগ্রস্ত। উদ্বেগ ও বিষণ্নতাজনিত অসুস্থতায় ভোগা মানুষের হার ছিল প্রায় ১১ শতাংশ।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হাসপাতাল ও ক্লিনিক শাখার পরিচালক দাউদ আদনান বলেন, দেশের যেসব হাসপাতালে কভিড ইউনিট আছে, সেখানে পোস্ট কভিড ক্লিনিক চালু করা হয়েছিল। তবে করোনা নিয়ন্ত্রণের পর থেকে সেগুলো সেভাবে আর  চালু নেই। রোগী থাকলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে এসব ক্লিনিকে ফের চিঠি দেওয়া হবে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বলেন, যাদের কো-মরবিডি অর্থাৎ ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি, লিভার, স্ট্রোক ও হার্টের সমস্যা রয়েছে, করোনা তাঁদের বিপদ বাড়াচ্ছে । ক্যান্সার চিকিৎসায় যারা কেমো বা রেডিও থেরাপি নিয়েছেন বা নিচ্ছেন তাঁদের ক্ষেত্রে এটা ভয়ংকর হতে পারে। করোনা থেকে মুক্ত হলেও এক বছর নিয়মিত চিকিৎসকের অধীনে থাকতে হবে। হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করা জরুরি।

তিনি আরও বলেন, যাদের উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট ও হার্টের সমস্যা রয়েছে, করোনা সেরে গেলেও এসব রোগ নিয়ন্ত্রণে আসছে না। অনেকে মাথাব্যথা, শরীরে হালকা ব্যথা ও ওজন কমার কথা বলছেন। ফলে হতাশা, উদ্বিগ্নতা ও বিষণ্ণতা বাড়ছে।  জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ও জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা সংস্থার উপদেষ্টা মোশতাক হোসেন সমকালকে বলেন, যেভাবেই হোক পোস্ট-কভিড রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করতে হবে।